আরও একবার – অন্তিম পর্ব

by Tamali

“দেখো অয়ন তুমি চাপে আছো বুঝতে পারছি,কিন্তু এ’কদিন আমার সাথে যা করেছ তার সাথে এর কোনো যোগ আছে কি?একবারও ভাবনি আমার বাবাও ওখানে আছে,আমারও একই টেনশন আছে। আর সবচেয়ে বড় কথা এই যে তোমার মা,আমার বাবা দুজনেই তো দুজনের দায়িত্ব। মা অসুস্থ হতে আমি কি চিন্তা করিনি? আগে এগুলো বিশ্বাস করো তবে একে অপরের প্রতি ভরসা তৈরি হবে।আমি যে অয়নকে বিয়ে করেছিলাম আর শেষ তিনমাস যার সাথে থেকেছি,তারা এক নয়”,মানিনী কথা গুলো বলে ফেলে নিজের বাইরের কঠিন আবরণটা ছিঁড়ে।
অয়ন আর ও ডাইনিং রুমে এসে বসেছে। কিন্তু অয়নের মুখে ওর সমস্যা সবটা শুনেও মানিনী ওর সাথে অয়নের ব্যবহারের কারণ খুঁজে পায়নি।
“সরি মানি।আমি কোনোদিনও মা’কে ভেঙে পড়তে দেখিনি,মা আমার শক্তি,তাই এখানে আসার পর মায়ের ওই রোগ আমায় সব বোধ ভুলিয়ে দিয়েছিল। তবে তোমার সাথে মায়ের সম্পর্ক ও আমায় খুব কষ্ট দিত।সব মিলিয়ে…আমার মা কিন্তু আমাদের ভালোই চায়”,অয়ন গুছিয়ে বলতে পারেনা পুরোটা।
মানিনী কিছুক্ষন চুপ থাকে,তারপর আস্তে আস্তে বলে,”সব মা বাবা ই সন্তানের ভালো চায়।কিন্তু আমার নিজের অভিজ্ঞতা হয়তো আমার মনে শাশুড়ি সম্পর্কে একটা অবয়ব তৈরি করে দিয়েছে,বিশেষ করে উৎসবের মা যেরকম ছিলেন,তাই আমারও হয়তো অনেক সময়ে তোমার মা’কেও বুঝতে ভুল হয়েছে। কিন্তু বিশ্বাস করো এই লকডাউনে আমিও সবসময় ভেবেছি ওদের কথা।কিন্তু আমার সত্যি অপশন ছিল কি? ওই একদিনের জন্য হলেও আসতে হত। দেখো না নেক্সট উইক থেকে অফিস যেতে হবে দুদিন,সেই নিয়ে ঝামেলা চলছে। আর ইচ্ছা করে এখানে এসে কী লাভ বলতো আমার? বিয়ে না হয়ে,একা থাকলেও আমায় চলে আসতে হতো। আর সেদিন তুমি যেটা বললে আমি একা আসলেই ভালো হতো,হয়তো হতো,কিন্তু এই অপশনটা আমি কেন তুমিও ভাবনি তখন।এখন তো মনেহয় তাতে সম্পর্কটা আর যাইহোক এতোটাও নড়বড়ে হয়ে যেত না”,মানিনীর গলার অভিমান আবার অনেকদিন পর অয়নের কানে ধরা দেয়। অয়ন ওকে হাতের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে আস্তে করে বলে,” সরি।আসলে তখন একদম মাথা কাজ করছিল না। কিন্তু সত্যি কি তোমায় একা আমি ছেড়ে দিতাম? তখন কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আর সত্যি তো বাবার জন্যেও আমার একই চিন্তা হয়।এই মহামারী সত্যি মানুষকে বড্ড অসহায় আর অধৈর্য্য করে দিয়েছে।রাতদিন চার দেয়ালে বন্দী থাকতে থাকতে মানুষ হাঁফিয়ে গেছে, বদলে গেছে। আমি কতটা অমানবিক হয়ে গিয়েছিলাম পরে আমি ভেবেছি,তুমি কাজ করছো একা দেখেও আমি চুপচাপ বসে থেকেছি।আমি নিজেই এই আমিকে চিনতাম না,আজ যখন দুপুরে বসে নিজেকে নিয়ে ভাবলাম খুব ঘেন্না হলো নিজের ওপর। এটা আমি কী করছি,কিছুতেই কিছু মেলাতে পারলাম না। সত্যি বলতে মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছি আমরা এই ভাবে থাকতে থাকতে…”,অয়ন আনমনে অনেক কিছুই বলতে থাকে।
মানিনী অয়নের মুখের দিকে তাকায় এবার,বুঝতে পারে প্রাণচঞ্চল ছেলেটা কেও করোনা কালের ডিপ্রেশন ছুঁয়ে গেছে।নিজে জানে এই ডিপ্রেশন কতটা মারাত্মক।ও নিজেও যে পুরোপুরি বেরোতে পেরেছে তা তো না। এখন মাঝে মাঝে হোমিওপ্যাথি অ্যান্টিডিপ্রেশন ওষুধ খায়,যে টা অয়ন জীবনে আসার আগে রেগুলার খেত।
অয়নের হাতে হাত রেখে মানিনী বলে,”আচ্ছা অয়ন তুমি তো জানতে আমি ডিপ্রেশনের পেশেন্ট। তোমার ভালোবাসা আমায় নতুন প্রানশক্তি দিয়েছিল , আবার ভালোবাসার সাহস দিয়েছিলো, তুমি সবটা জানতে। তুমি আগলে রেখে আমায় স্বাভাবিক করেছিলে, কিন্তু সেই তুমি একই ব্যবহার কী করে ফিরিয়ে দিতে পারলে? এক দুদিন না, টানা তিনমাস এরকম দমবন্ধ পরিবেশ দিয়েছো তুমি। একবারও ভাবোনি আমার মানসিক অবস্থার কথা। আমি চাইলেই তোমার যুক্তি উড়িয়ে দিয়ে নিজের মানসিক শান্তির জন্যে তোমার থেকে দূরে চলে যেতেই পারি। কিন্তু তুমি আমায় যেভাবে ওই সময় সাপোর্ট দিয়েছিলে সেটা মনে আছে বলেই আরও একবার আমি নতুন করে শুরু করতে চাই। কিন্তু এটাই শেষ সুযোগ, আমাদের দুজনের কাছেই। আমরা আগে যেমন সব কিছু একে অপরকে বন্ধুর মত বলতাম, সেভাবেই যেন বলি। আর এবারে যদি আর কোনো ভুল বোঝাবুঝি আমাদের মধ্যে তৈরী হয় তাহলে ধরে নিতে হবে আমাদের সম্পর্ক বন্ধু হিসেবেই বেস্ট, আমরা স্বামী স্ত্রী হিসেবে থাকার জন্যে ঠিক না”।
মানিনী বুঝতে পারে ও খুব সাধারণ টোনে কথাগুলো বললেও, শুনতে শুনতে অয়ন ওর হাতটা আঁকড়ে ধরছিল। ওর চোখে ফুটে উঠছিলো একটা হারানোর ভয়। কিন্তু মানি জানে কথাগুলো ও মন থেকে বলেছিলো। এই খারাপ ব্যবহার, অবজ্ঞা এগুলো ও নিতে পারেনা এখন। বড্ড চাপ পড়ে মনে, শরীরেও তার প্রভাব পড়ে।
“মানি আমি যেটা করেছি খুব ভুল করেছি। কিন্তু কখনো ভাবিওনা তোমাকে ছাড়া বাঁচার কথা। হ্যাঁ মাও আমার জীবনে প্রচন্ড দামি, কিন্তু তোমাকে আমি নিজে আমার জীবনে এনেছি তাই দায়িত্বটা তোমার প্রতি বরাবর বেশি। ভুল তোমরা কেউ না, ভুল আমি ছিলাম…”, অয়ন কথার মাঝে বাধা পায়।
“অয়ন সব সম্পর্কে সময় লাগে। আর কিছু জায়গায় কিছু জিনিস সময়ের ওপর ছেড়ে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ “, মানি জানে ওর ও বুঝতে ভুল হয়েছিল অয়নের মা’কে, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ও নিজের ভুল নিজেই বুঝেছে। ওর আশা সময় ওদের শাশুড়ি বৌমার সম্পর্ক হয়তো ঠিক করে দেবে।
মানিনী আবার বলতে শুরু করে অয়ন বলার আগেই,”এসব নিয়ে তুমি ভেবোনা, তুমি তোমার কেরিয়ার নিয়ে ভাবো, আমার মনেহয় এই মহামারী এই সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রিটা কে খুব অনিশ্চিত করে দিয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখছি তো, তুমি চাকরি ছাড়াও অন্য কিছু নিয়ে ভাবো। আমি জানি সৌরভদার কাজে তোমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই, তাও ওর সাথে একবার যদি…”, এবার মানিকে থামিয়ে দেয় অয়ন।
“আমি ওর সাথে কথা বলেছি মানি। সৌরভ বিষয়টা টাকা খরচ করে শিখলেও এখন ও অন্যদের শেখায়। জিনিসটা সম্পর্কে আমার নলেজ জিরো। ওকে দুপুরে ফোন করেছিলাম। কথা হয়েছে। ও কিছুদিন আমায় শেখাবে, আপাতত অফিস টাইমেই ওর সময় মতো শিখবো, তারপর যদি কোনো প্রজেক্ট পেয়ে যাই তখনও ভেবেছি এটা কন্টিনিউ করবো। জানিনা কবে সব নরমাল হবে!কিন্তু তুমি এখনও এই পরিস্থিতিতে কী করে অফিস যাবে? যদি তোমার কোনোভাবে ইনফেকশন হয়ে যায়?” অয়নের সেই পরিচিত টোন মানিনীর কানে অনেকদিন পর আরাম দেয়। মনেহয় ও যেন একটা দুঃস্বপ্নের মধ্যে ছিল। বাইরের মহামারী এতদিন যেন ওর বাড়িতেও দখল নিয়েছিল।
ও অয়নের মুখের দিকে অপলকে কিছুক্ষন তাকিয়ে বলে, “তুমি তো আছো, সেবা করবে। ছেড়ে পালাবে না মনে হচ্ছে আর… “, মানিনীর কথা শেষ হওয়ার আগেই লজ্জায় অয়ন ওর কোলে মুখ গুঁজে দেয়। দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে ওর কোমর।
“ওঠো অয়ন। যা হওয়ার হয়েছে। হয়তো আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা একটা পরীক্ষা ছিল। তবে আমার কিছুদিন সময় লাগবে। আমি একটা কথা বলি, মন দিয়ে শোনো। এখন ফ্লাইট চালু হয়েছে, তুমি বাড়ি চলে যাও। মার কাছে কদিন থেকে এসো। আমিও তাহলে কিছুদিন নিশ্চিন্তে অফিস করি, যাতে আমার কিছু হলে তোমায় না সেটা এফেক্ট করে। নাহলে অফিস গেলেও আমার তোমার জন্যে দুশ্চিন্তা…”, মানিনী কথাটা শেষ করতে পারেনা।
“এই সবে বললে আমি আছি, ছেড়ে যাবোনা, আর পরোমুহূর্তে ছেড়ে যাওয়ার কথা বলছো? আমার মায়ের জন্যে মন খারাপ করছে না সেটা বলবো না, কিন্তু মায়ের জন্যে ওখানে অন্তত মামারা আছে, এখানে তোমার আমি ছাড়া কে আছে? যা হবে দেখা যাবে, দুজনের হবে। ছাড়ো ওসব কথা। চলো আমরা আবার নতুন করে সব শুরু করি,প্রমিস আর তোমায় কোনো অভিযোগের সুযোগ আমি দেবোনা। চলো চা করা দিয়ে শুরু করি। আর তোমার যতদিন খুশি সময় নাও, কিন্তু প্লিজ আমার থেকে দূরে যাওয়ার কথা আর বলোনা। আমার মধ্যে জানিনা কোথা থেকে একটা শয়তান এসে ভর করেছিল, আগে কখনো কারোর সাথে যা ব্যবহার করিনি আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার সাথে কিকরে এটা করলাম, জানিনা। সরি মানি, আই’ম এক্সট্রিমলি সরি।”
“ঠিক আছে অয়ন, কেন এক কথা বারবার বলছো? কিন্তু তোমার যখন ই মায়ের জন্যে মন কেমন করবে, ঘুরে আসবে। আমি ঠিক নিজের খেয়াল রাখতে পারবো তখন”, মানিনী এতক্ষন পর মন থেকে অয়নকে একটু একটু বিশ্বাস করতে পারে।
অয়ন উঠে চলে যায় মানিনীর জন্যে চা বানাতে। মানি ওখানেই চুপচাপ বসে থাকে। আজ ও বুঝতে পারে সম্পর্ক আসলে জটিল এক অংক। হয়তো উৎসবের সাথেও ওর সম্পর্ক ও চাইলে মেটাতে পারতো, কিন্তু তখন অয়ন এসে গিয়েছিলো ওর জীবনে। তাই উৎসবের ওই অধিকারবোধ ওর দমবন্ধকর লেগেছিলো। অয়নকেও তো দ্বিতীয় সুযোগ দিলো, কিন্তু উৎসব 333mকে দিতে পারেনি। কারণ উৎসব ওর ডেসটিনি ছিলোনা।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও। সেই বিশ্বাস, সেই জোর কবে আবার অয়নের প্রতি ফিরে আসবে ও জানেনা । এতদিন যেন মানি অন্য একটা মানুষের সাথে এক ছাদের তলায় বাস করছিলো। হয়তো ওর অতীত ওকে আজকাল সহজে ক্ষমা করা ভুলিয়ে দিয়েছে। বারবার অয়নের মধ্যে উৎসবকে দেখেছে মানি শেষ কমাসে, ফলে পুরোনো অয়নের স্মৃতিতে ধুলো পড়েছে। সেই ধুলো সরে আবার পুরোনো সেই ছেলেটাকে খুঁজতে ওর সময় সত্যি লাগবে। আবার নতুন করে শুরু করতে হবে প্রথম থেকে।ওর আর অয়নের সম্পর্কের প্রথম মান অভিমান, আর সেটা এতটা দীর্ঘকালীন তাই হয়তো এতোটা প্রভাব পড়ছে। এভাবেই হয়তো সম্পর্কটা পরিণত হয়ে উঠবে।
অয়ন ও একই কথা ভাবতে ভাবতে চা করতে থাকে।
অয়ন ভাবতে থাকে মানিনীর মন নতুন করে জয় করার কথা,যেন একটা কুয়াশা ওর মনটা ছেয়ে রেখেছিলো। অনেকদিন পর ও সেটা ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছে।আসলে মানিনীর সাথে বিয়ে ওকে ওদের সম্পর্ক নিয়ে এতটাই নিশ্চিত করে দিয়েছিলো ও ভুলে যাচ্ছিলো সব সম্পর্কের যত্নের প্রয়োজন। ফলে ওর অজ্ঞতার কারণে আজ মৃতপ্রায় হয়ে গেছে ওদের সম্পর্ক, যেটা সাধারণ ক্ষমা দিয়ে স্বাভাবিক হবে না সেটাই স্বাভাবিক। বরঞ্চ দরকার সময়ের, আর ওর ভালোবাসার আর যত্নের যা কোনো একদিন হয়তো আবার সব কিছু স্বাভাবিক করে দেবে। নিজেকে ও নিজে নতুন করে তাই প্রমিস করতে থাকে অনেক কিছুর, মনে মনে দায়িত্ব নিতে থাকে সম্পর্কটায় প্রান ফিরিয়ে আনার।
চায়ের কাপ দুটো হাতে নিয়ে অয়ন পা বাড়ায় ড্রয়িং রুমের দিকে সেই প্রথম দিনের মতো, প্রথম থেকে নতুন করে সব কিছু শুরু করার লক্ষ্য নিয়ে।
মহামারীর বিষ প্রভাবে এভাবেই সম্পর্ক গুলো নড়বড়ে হয়ে কত সম্পর্ক যে হারিয়ে গেছে তার কোনো সঠিক হিসেব হয়তো নেই।
মানি অয়ন সামলে নিলেও পুরোনো সম্পর্কে কবে ফিরতে পারবে নিজেরাও জানেনা। ওরা আরও একবার নতুন করে শুরু করতে চাইছে নিজেদের সম্পর্ক।কিন্তু দুটো মন এক হয়ে দুটো শরীর মিশে যাওয়ার দিনটা ওরা বেশ কিছুটা পিছনে ফেলে এসেছে, তাই আবার কিছুটা পিছিয়ে ওদের নতুন শুরুর শুরুটা হয়তো করতে হবে। হয়তো এভাবেই শেষ হয়ে যাওয়া আটকে আরও একবার সম্পর্ক কিছুটা পিছিয়ে শুরু করাটাই ঠিক কাজ। সেই জায়গা থেকে শুরু করা ঠিক যেখান থেকে ভুল বোঝাবুঝি শুরু হয়েছিলো। তবেই ভবিষ্যতে নড়বড়ে অংশের ক্ষত বইতে হয়না।
অয়ন মানিনী আরও একবার নতুন করে ভালোবাসার, বিশ্বাস করার অঙ্গীকার করে শুরু করে ওদের নতুন সম্পর্ক। শুরু হয় অন্য এক ভালোবাসা আর লড়াইয়ের গল্প।

সমাপ্ত।

You may also like

Leave a Comment

error: Content is protected !!