তুমি কেন বোঝোনা – চতুর্থ ভাগ

by Tamali

“কিরে শালা কমিউনিকেটরে পিং করলি না আজ…একা একাই লাঞ্চ করতে চলে এলি।আমি তোর স্ট্যাটাস ‘অ্যাওয়ে’ দেখে খুঁজতে খুঁজতে ক্যান্টিনে এলাম।”ঋষির পিঠে একটা চাপড় মেরে অতনু বললো।কিন্তু একেই সকাল থেকে ঋষির মেজাজ তেতো হয়ে আছে,তার ওপর অতনুর হঠাৎ আগমন আর পিঠে চাপড় খেয়ে মাথা গেল গরম হয়ে।ভুলে গেল ও ক্যান্টিনে আছে,প্রচন্ড জোরে চেঁচিয়ে বললো,”কেন রে শালা আমি কি সবার কাছে দস্তখত দিয়ে রেখেছি যে কখন কোথায় যাচ্ছি সবাইকে বলে যাবো?কেউ আমার পরোয়া করে?নিজের খিদে পেলেও তোর অপেক্ষায় থাকবো,তোকে পিং করবো,তুই পারমিশন দিবি বা সাথে আসবি তবে বসে থাকবো?!!কি ভাবিস কি তোরা আমায়?….”।

“এই ঋষি কি উল্টোপাল্টা বকছিস পাগলের মতো এই পাবলিক প্লেসে!তোর কি মাথা একদম গেছে,কি কথার কি উত্তর দিচ্ছিস তুই?”অতনু হকচকিয়ে গিয়ে বলে।”হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ আমি পাগল।তুইও তাই বল, তাহলে আরও অনেকের সুবিধা হয়ে যায়।আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা সহজ হয়।”ঋষির মাথায় সারাক্ষন ঘুরতে থাকা চিন্তাগুলোর আউটবার্স্ট হয় অতনুর কথাতে।ওর হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায়।অতনু এবার একটু মনোক্ষুন্ন হয়।ও একটু হুল্লোড়ে,হাসি মজা করে থাকে বলে সবাই ওকে হালকা নিয়ে থাকে।ওকে কিছু বলার সময় কেউ ভেবে কিছু বলেনা।কিন্তু অকারণ এসব কথার ও কোনো কারণ খুঁজে পায়না।শেষ একসপ্তাহ ঋষি দুপুরের খাবার অফিস ক্যান্টিনে খাচ্ছে,বিয়ের পর থেকে যা ও করতো না।অতনুর একটু সন্দেহ হলেও কিছু জিজ্ঞেস করেনি ওকে।আর অতনু বরাবরই লাঞ্চ অফিস ক্যান্টিনে করে বলে ওরা একসাথেই খেয়েছে শেষের কদিন,তাই স্বাভাবিক ভাবে আজও ও অপেক্ষা করেছিল ঋষির ডাকের।এমনিতেও ঋষি আর অতনু সমবয়সী,এক কলেজ না হলেও এক ইয়ারে পাস আউট।তারপর এই কোম্পানির একই দিনে ওদের জয়েনিং ছিল,তাই শুরু থেকেই ওদের দুজনের কেমিস্ট্রি আলাদা।অতনু চুপ করে যায় ঋষির ভিত্তিহীন অভিযোগে।নিজের মনে অর্থহীন বকার মাঝে হঠাৎ ঋষিরও চোখ পড়ে অতনুর দিকে…চোখটা নামিয়ে টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছে..কথা জড়িয়ে যায় ঋষির।ঋষি অনুভব করে নিজের হতাশা অকারণে অতনুর ওপর উগরে কোনো লাভ নেই,বেচারা অহেতুক কষ্ট পাবে।আর ও ঋষিকে এতটাই ভালোবাসে যে কষ্ট পেলেও প্রতিবাদ করবে না।ঋষিও চুপ করে যায়।দুজনে চুপ করে মুখ অন্যদিকে করে একে অপরের মুখোমুখি বসে থাকে।মিনিট পাঁচেক পর ঋষি মৌনতা ভাঙে,ডান হাত দিয়ে অতনুর বাঁ হাত সামান্য চাপ দিয়ে বলে,”সরি ইয়ার।আসলে আজকাল হঠাৎ হঠাৎ মাথা গরম হয়ে যায়,মাথা কাজ করেনা।আর তখন নিজের কথার ওপরেও কোনো কন্ট্রোল থাকেনা।সরি সরি…কিছু মনে করিসনা”।অতনু বোঝে ঋষির সরিটা একদম আন্তরিক।নাহলে পাবলিক প্লেসে এত সহজে সরি বলার বান্দা ঋষি  মুখার্জী নয়। সাথে এটাও বোঝে ঋষির মনে কোনো কারণে অস্থিরতা চলছে,যা ওর কারোর সাথেই ভাগ করে নিতে পারছেনা।অতনু যেচে কিছু জানতে চায়না, শুধু ভরসা দেওয়ার ভঙ্গিতে নিজের অপর হাতটা ঋষির হাতে রাখে।হয়তো এইটুকু ভরসার দরকার ছিল ঋষির,অতনুর মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের মনের মধ্যে জমে থাকা কথা গুলো বলে ফেলে।অতনু অবাক হয়ে শোনে…ঋষির মধ্যে একসাথে দুটো মানুষের কথা।কখনো মনেহয় ও অহনার জন্যে ভীষণ চিন্তায় আছে,আবার কখনো উগরে আসে ওর প্রতি রাগ আর ক্ষোভ।আসলে ঋষি হয়তো নিজেই বুঝতে পারছেনা ও কি চায়।অতনু ভাবে বাইরে থেকে দেখা আর সংসারের মধ্যের ঘটনার কত তফাৎ।ঋষি কে দেখে দশ দিন আগেও মনে হয়েছে সুখী দাম্পত্য জীবন।ঋষির বাইরের হুল্লোড় বিয়ের পর বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি,উল্টে সংসারের চাপ কমে গেছিল।বাইরের খাবার খেতে হতোনা।অতনু ভেবেছিল অহনা সবটাই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে।কিন্তু আজ অতনুর মনে হলো অহনার ওপর অনেকটাই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল।আজ ঋষির কথায় বারবার ওর নিজের উদারতার কথা প্রকাশ পাচ্ছিলো অহনার মতো অনাথ মেয়েকে বিয়ে করার জন্যে।অহনা হঠাৎ চলে গিয়ে ওকে সমস্যায় ফেলতে চেয়েছে এটাই ছিল ঋষির ধারণা।অতনুর বারবার সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল ঋষির কথা শুনে।ও বিয়ের আগের ঋষির সাথে এই ঋষি টা কে ঠিক মেলাতে পারছিল না।বড় বেশি হিসেবি লাগছিলো ওর নিজের বন্ধুটা কে।কিন্তু একদিন সত্যি তো এই ছেলেটা অহনা কে দেখে ওর প্রেমে পাগল হয়েছিল।নিজের পিসতুতো দিদির বিয়ের পর অহনাদের বাড়ি থেকে ফিরে থেকে অতনুকে অহনার কথা বলে পাগল করে দিত।ঋষির মেয়ে দেখলেই প্রেমে পড়া একটা অভ্যেস ছিল,কিন্তু কেন কে জানে সেদিন অহনার ক্ষেত্রে অতনুর মনে হয়েছিল ব্যাপারটা অনেক সিরিয়াস।বিশ্বাস করেছিলো ও ঋষির অনুভূতি আর আবেগ কে।আসলে জীবন এরকমই অনিশ্চিত,এটাও অতনু জানে ।ওর মন-মস্তিক খুঁজতে থাকে উপায় ,যাতে ওর বন্ধু ঋষি আর অহনা আগের মতো একসাথে হয়ে যেতে পারে।

“অহনা দেখ কে এসেছে।”রাজীবদের বাড়িতে অহনার ঘরের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে রুক্মিণী অহনাকে ডাক দেয়।নিজের চোখের ওপর হাত দিয়ে দুপুরে খাওয়ার পর শুয়েছিল অহনা।গতকাল রাজীব ওকে বুথের সামনে থেকে যখন রিকশায় চাপায়,জ্ঞান ফিরে আসলেও একটা ঘোরে ওর চিন্তা আচ্ছন্ন হয়েছিল।কাল অনেকবার বারণ করা স্বত্ত্বেওও রুক্মিণী ওর কাছে শুয়েছিল রাতে,অহনা জানে রাজীবের নির্দেশও ছিল রুক্মিণীর ইচ্ছা ছাড়াও।ডাক্তারের দেওয়া ঘুমের ওষুধেও হয়তো ঘুম আসতো না যদি ও একা শুতো।রাজীব ওকে বাড়ি নিয়ে আসার পর থেকে কারোর সাথেই বিশেষ কথা অহনা বলেনি।শুধু রুক্মিণী কে বলেছিল,”একটু সুস্থ হলেই আমি চলে যাবো।তোদের বড্ড বিরক্ত করছি জানি,কিন্তু কি করবো বল!শরীরটা হঠাৎ এমন বিগড়ে গেল।”রুক্মিণী কপট রাগ দেখিয়ে বলেছিল,”হ্যাঁ খুব বিরক্ত করছিস তুই।আর সহ্য হচ্ছেনা।”অহনা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালে হাত তুলে মারের ভঙ্গি করে রুক্মিণী বলে,”মার খাবি আমার হাতে?এই তোর ভালো বন্ধুত্ব!আমি জানিনা অহনা তোর কি হয়েছে,শুধু জানি তুই কোনো কারণে ভালো নেই,সেই ভালো না থাকার দিন গুলো নাহয় আমাদের সাথেই কাটিয়ে দে, আর খুব তাড়াতাড়ি ফিরে যা ভালো সময়ে।তোকে সারাজীবন হাসিখুশি দেখেছি,এই বিধ্বস্ত, ক্লান্ত মুখটা দেখতে ভালো লাগছেনা।আর কিছু চাইনা।আমি জানি তুই খুব পরিণত,যাই হোক একদিন ঠিক সব কাটিয়ে উঠবি।তোর সেই চোখভরা হাসি মুখটা দেখার জন্যে ‘আমরা’ মরে আছি।”ওর ‘আমরা’ কথাটায় জোর দেওয়ার কারণ অহনা বুঝতে পারে,কিন্তু কিছু বলেনা।ওকে নিয়ে আসার সময় রাজীব কোনো প্রশ্ন তো করেইনি, বরং ওকে একটা রিক্সায় উঠিয়ে দিয়ে নিজে পাশে পাশে স্কুটি চালিয়ে এসেছে।তাই রাজীবের কথা কিছু জানার ইচ্ছাটাই অহনার নেই।হঠাৎ সমস্ত পুরুষ জাতিটার ওপর ওর কেমন যেন একটা অবিশ্বাস এসে গেছে রাতারাতি।কাল থেকে সারাক্ষন ওর মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরছে,’এবার কি?’..মাথা নিচু করে ফিরে যাবে নাকি পুরোপুরি হারিয়ে যাবে চেনা জগৎ ছেড়ে।যদি একান্তই ফিরতেই হয়,মাথা নিচু করে ঋষির বাড়িই সোজা যাবে,আর নিজেকে গুটিয়ে খোলসে পুড়ে নেবে,আর মাথা তুলে কোনোদিনও দাঁড়াবে না,আর কোনোদিনও যাবেনা দাদাভাই এর বাড়ী।ঋষির বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত ওর ছিল,কিন্তু নিলয়ের কথা ওর জীবন শক্তি শুষে নিয়েছে,বিশ্বাস হারিয়ে গেছে ওর আপনজনদের ওপর।রুক্মিণীর কথায় উঠে বিছানায় বসে অহনা অবাক হয়ে যায়…দরজায় দাঁড়িয়ে আছে শ্রীলেখা,ওর বৌমনি।”কিরে শরীরের কি হাল করেছিস?রুক্মিণী বলছে প্রেশার প্রচন্ড লো।…খাওয়া দাওয়া ঠিকঠাক করতিস না জানতাম।কিন্তু একদমই কি খেতিস না নাকি?”শ্রীলেখা এসে অহনার বিছানার এক কোনে বসে।রুক্মিণী তাড়াতাড়ি একটা চেয়ার এনে দেয় নিজের ঘর থেকে।তারপর ওদের দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমরা কথা বল আমি একটু কফি করে আনি।আজ ঠান্ডাটা ভালোই পড়েছে।”বলে ও ওদের দুজনকে একটু আলাদা কথা বলার সুযোগ দিয়ে ঘরের দরজা টেনে দিয়ে চলে যায়।”তুমি রুক্মিণী কে ফোন করেছিলে?কেমন আছো তুমি?”অহনার গলার স্বর একেবারে জোর নেই,প্রাণহীন সেই আওয়াজে শ্রীলেখার মন কেঁদে ওঠে।ও চেয়ার ছেড়ে আবার অহনার পাশে গিয়ে বসে ওর মাথায় হাত রাখে,”কেমন আছিস বোন?এতদূর চলে আসার আগে তোর এই দিদিটা কে একটা ফোন করতে তো পারতিস।কি এমন হলো যে নিজের সংসার ফেলে চলে এলি?”অহনা চুপ করে থাকে, আর কাউকে কিছু বলতে ওর ইচ্ছা করেনা।ও শুধু শারীরিক ভাবেই ক্লান্ত না,মানসিক ক্লান্তিতে ওর চোখ যেন বুজে আসে।একটা অনাত্মীয়ের বাড়িতে এসে তিন চারদিন হল আছে,সারাক্ষন শুয়ে, ঘর ছেড়ে বেরোতে পারছেনা,তারা কি ভাবছে কোনো কিছুই যেন ওকে স্পর্শ করেনা আজকাল আর কোনো খারাপ লাগার অনুভূতিও তৈরি করেনা।কালকের ওর দাদার কথা গুলো যেন অর্ধমৃত করে দিয়েছে।বরং এখানকার প্রকৃতির শান্তি ওকে খুব আরাম দেয়।ঋষি বাড়ি থাকলেই সারাক্ষন চলতে থাকা কিচির মিচির,দোষারোপের পালা ওকে অনেক আগেই জীবন্মৃত করে দিয়েছিল,ভরসা ছিল নিলয়।কিন্তু তার আঘাত ওকে পুরোপুরি বোবা করে দেয়।শ্রীলেখা বুঝতে পারে অহনা সহজে কথা বলবে না।মানুষের মৃত্যুর মতোই সম্পর্কের মৃত্যুও আসলে অনেক সময় মানুষকে পাথর করে দেয়।ও আস্তে আস্তে অহনার হাতে হাত রাখে।”চল বোন বাড়ি চল।এরকম অসুস্থ অবস্থায় কতদিন অন্যের আশ্রয়ে থাকবি?তোর বিশ্রাম দরকার বেশ কিছুদিনের,এরা কতদিন করবে বল?”

“তোমায় রুক্মিণী ফোন করেছিল বৌমনি?না তুমি করেছিলে?”অহনা বুঝতে চায় রুক্মিণী নিজের অসুবিধার কথা বলেছে,নাকি বৌমনি ওকে ফোন করে ঠিকানা জেনে এসেছে!”আমি তোর দাদার ফোন থেকে রুক্মিণীর নম্বর নিয়ে কাল রাতে ফোন করি তোর খবর জানতে।ফোনটা কমন স্পেসে ছিল,আর রুক্মিণী ওখানে ছিলোনা।ফোনটা রাজীব ধরে।তখনই জানতে পারি তুই রাজীবের বাড়িতে আছিস।তোর দাদাভাই কিছুই জানেনা।আমি বাপেরবাড়ি গিয়ে একদিন থাকার নাম করে এখানে এসেছি।জানিসই তো তোর দাদাভাই কে তুই এখানে আছিস জানলে তোর প্রতি ভালোবাসা,বিশ্বাসে আঘাত লাগবে।তোকে ভুল বুঝবে।তার চেয়ে চল ঋষির কাছে না ফিরিস,নিজের পুরোনো বাড়িতে থাকবি চ।….”শ্রীলেখা কথা শেষ করতে পারেনা,দেখে অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে অহনা।অহনা বুঝতে পারে বৌমনি কিছুই জানেনা ওর আর দাদাভাইয়ের ফোনে কথার ব্যাপারে।ও অবাক হয় ওর দাদা বৌদির সম্পর্কেও এতটা ফাঁক আছে দেখে।যে দাদাকে ও পারফেক্ট হাসবেন্ড ভাবতো সেও আসলে দাম্ভিক সেটা কেন জানেনা ওর মনে হতে থাকে বারবার।সব মেয়েরই সংসারে জায়গাটা স্পষ্ট হতে থাকে ওর মনের চোখে ধীরে ধীরে।ও শুধু ধীরে ধীরে বলে,”দাদাভাই হয়তো তোমার অনেক আগে থেকেই জানে আমি কোথায় আছি।জানিনা তুমি আমায় সত্যি বলছো না কি দাদাভাই নিজের বোনকে কলঙ্কিনী ভেবে সম্মান বাঁচাতে তোমায় পাঠিয়েছে।কিন্তু এভাবে তো আমি ফিরবনা বৌমনি,একা যেভাবে বেরিয়ে এসেছিলাম ফিরতে হলে সেভাবেই ফিরবো।আমার জন্যে অহেতুক তোমাদের অপমানিত বা ছোট হতে হবেনা।”এইটুকু কথা একটানা বলে অহনা হাঁফাতে থাকে।এবার অবাক হয় শ্রীলেখা।”তোর দাদাভাই জানে?আর তুই বা সেটা জানলি কিকরে?আর আমি মিথ্যে বলবো সেটা হঠাৎ কেন মনেহল তোর?আমি তোর কথা কিছুই বুঝতে পারছিনা।তোকে তো আমি চিনতেই পারছিনা অহনা”,শ্রীলেখার গলায় হতাশা-খারাপ লাগা সব একসাথে ঝরে পড়ে।বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অহনা তার বৌমনি কে সবটা বলে,যা ওকে নিলয় ফোনে বলেছিল।”সত্যি কি জানো বৌমনি,আমরা প্রতিটা মেয়েই আসলে এই পৃথিবীতে ভীষণ একা।একটা ছেলে,সে আমার বাবা-দাদা-স্বামী-বন্ধু যেই হোক,আমায় পুরোটা বুঝবে এটা ভাবাই ভুল।আর মেয়েরা মেয়েদের বুঝবে এটাই সচরাচর হয়না,অনেক ক্ষেত্রে নিজের মা ও বুঝতে পারেনা।আমি জানিনা আমি এবার কি করবো,কিন্তু যদি ঋষির কাছে ফিরেও যাই কি লাভ হবে?আমি কি ভালোবাসার টানে ফিরবো?আমি রাগ,অভিমান,ভুল যে কোনো কারণেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসিনা কেন এ’কদিনে সে আমায় ফোন করা দূরে থাক সেভাবে খোঁজ অবধি করেনি। আমায় ভালোবাসলে ফিরে যাওয়ার কথা বলতো,ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতো…কিছুই সে করেনি।হয়তো মেয়েদের জীবনে এটাই স্বাভাবিক।মেয়েদের অহংকার থাকতে নেই,স্পর্ধা দেখাতে নেই।কিন্তু এ’কদিনে ঋষির প্রতি ভালোবাসা বাড়েনি আমারও,উল্টে টানটাও গেছে কমে।আমার ধারণা ঋষিরও তাই।তাহলে আমি যদি ঐ সংসারে ফিরি নতুন করে তৈরি করা সংসার কি আদৌ সুন্দর হবে?…আমি জানি সংসার এক সমঝোতার জায়গা।কিন্তু কতদিন এক তরফা সমঝোতা সম্পর্ক সুন্দর রাখতে পারে বলতো?তুমি জানো বিয়ের পর দুবছর আমি খালি খিদমতগারি করে গেছি।রাতে বিছানায় বেশির ভাগ দিন,সে আমার ইচ্ছা থাক কি না থাক,নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার পর সকালে উঠতে দেরি হলে একটা তরকারি,ডাল-ভাত রেঁধে দিয়ে শুনেছি আমার সুখের শরীর হয়ে গেছে।যে ছেলে বিয়ের আগে দু বছর বাইরের খাবার খেয়েছে, আমার প্রচন্ড জ্বরে রুটি কিনে আনতে বললে বলেছে দোকানের রুটি সহ্য হয়না।জ্বরের ওষুধ খেয়ে জ্বর কমিয়ে রান্না করে দিয়েছি।ছুটির দিনে ঘর পরিষ্কারে একটু সাহায্য চাইলে বলেছে ‘বউ আছে কি করতে?’…কত বলবো?বিয়ের পর থেকে ঘরে বাইরে সবটা আমার দায়িত্ব থেকেছে,কেননা আমি হোম মেকার,আর্থিক সাহায্য শূন্য।তাই যে সংসারে অর্থ দেবে,সে শুধু বাইরেই কাজ করবে,সংসারে তার বিশ্রাম নেওয়ার অবসর।তাও সবটা মানিয়ে নিচ্ছিলাম কিন্তু মিথ্যে সন্দেহে আমার সৃষ্টির প্রশংসা না করতে পারুক, যখন চোখের সামনে জ্বালিয়ে দিলো সেইদিন থেকেই মরতে শুরু করলো ভালোবাসা।…আচ্ছা বৌমনি,বউকে ভালো মন্দ খেতে পরতে দিলে,অন্য মেয়েতে আসক্তি না থাকলে,মারধর না করলে সেই স্বামী পরমেশ্বর হয়ে যায়?!!!নিজের শরীরের চাহিদায় আমায় জোর করে ভোগ করলে,আমার নূন্যতম সম্মান না করলে,সারাক্ষন নিজের মহানতার বুলি কপচে আমায় মানসিক ভাবে আঘাত করলে…সেগুলো কোনো দোষ নয় বলো?!!সংসারকে আগলে রাখা আমার দায়িত্ব কর্তব্য,কিন্তু আমার ভরণ পোষণ তার দায়িত্ব নয়…মহানতা।….এভাবে কি সারাটা জীবন চলে?…”, বাধা পায় অহনা শ্রীলেখার কাছে।”হ্যাঁ চলে,এভাবেই বেশিরভাগ মেয়ের সারাটা জীবন চলে।কটা মেয়ে পারে রে প্রতিবাদ করতে?তুই পারবি এই প্রতিবাদটা বজায় রাখতে?আমাদের মতো পরজীবীরা প্রতিবাদ করেই বা কোথায় যাবে?দোষ তো আমাদেরও কিছু কম না…শিক্ষিত হই আর না হই, বিয়ে করলেই নিশ্চিত সুখের জীবন ভেবে নিজের পায়ের তলায় মাটি শক্ত না করেই ছাতনা তলায় ছুটি নাচতে নাচতে।ভাবিনা পরের জীবনটা কি হবে?অনিশ্চিত ভবিষ্যতে পা দেওয়ার আগে কটা মেয়ে নিজের ভবিষৎ নিজের হাতে গুছিয়ে এগোয় বলতো?কিরে বল?তুই তো এম.এ পাস,কি দাম রেখেছিলি নিজের শিক্ষার?”শ্রীলেখা যেন নিজের হতাশাটাই ব্যক্ত করে ফেলে।এক দৃষ্টে অহনা শ্রীলেখার দিকে তাকিয়ে থাকে।পড়ে নিতে চায় ওর ভিতরটাও।তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্রীলেখার দিক থেকে চোখ সরিয়ে ঘরের জানলার কাঁচ দিয়ে দূরে তাকিয়ে বলে,”কাল আমি দাদাভাই কে নতুন করে চিনেছি বৌমনি।যেদিন ও তোমায় এক কাপড়ে বিয়ে করে বাড়ি নিয়ে এলো খুব গর্ব হয়েছিল নিজের দাদার জন্যে।কিন্তু কালকের দাদাভাই এর কথা আর আজকের তোমার কথা দুটোকে সামঞ্জস্য করে মনে হচ্ছে ঋষির আর দাদাভাই এর বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই।তুমি মানিয়ে নাও তাই তোমরা সুখী দম্পতি,আর আমি এতদিন চেষ্টা করার পর না পেরে পালিয়ে এসেছি তাই কারণ ছাড়াই আমি চরিত্রহীন।কিন্তু আমি সত্যি ওভাবে মুখ বুজে সারাজীবন কাটাতে পারবোনা যে,দুবছরেই হাঁফ ধরে গেছে আমার।ওই সংসারে আমি অন্তত দুশবার মরেছি।শুধুমাত্র কার জন্য জানো?তোমার আর দাদার জন্যে,যে দাদা নিজে হাতে মানুষ করা বোনকে অবিশ্বাস করে চরিত্রহীনা বলতেও দুবার ভাবেনি,গলা কাঁপেনি তার।.. “শ্রীলেখা চুপ করে থাকে,কিন্তু মনের মধ্যে চলতে থাকে হাজারো চিন্তা।ভালো করে বুঝতে পারে ঋষির ‘স্লোও পয়জনিং’ অহনাকে কঠিন করেছে,কিন্তু নিলয়ের কথা পুরোনো অহনাকে ভেঙে টুকরো করে দিয়েছে।ও আর কথা বাড়ায়না বেশি।শুধু বলে,”এবার কি করবি?তোর তো নিজের পায়ের তলায় মাটি নেই,বাঁচবি কিকরে?শুধু একটা কথা জানবি তোর ভবিষ্যতে তুই কি করবি পরের কথা,কিন্তু যত বেশিদিন এখানে থাকবি নিজের কলঙ্কের ইন্ধন জোগাবি।জীবনের চরম সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে চিন্তা কর।যে জোরে আমি তোকে নিতে এসেছিলাম,সব শুনে সেই জোর আর নেই।কিন্তু তোর দায়িত্ব এরাই বা কদিন নেবে?”

রাজীব যেটা সন্দেহ করেছিল সেটাই সত্যি হলো,আর না চাইতেও জেনে গেল ওর অহনার বর্তমান অবস্থা।কলেজ থেকে ফিরে রুকুর কাছে শুনেছিলো অহনার বৌদি এসেছে।বাবা মার অনুপস্থিতিতে ও যাচ্ছিল অতিথি আতিথেয়তার খবর নিতে,যেখানে রাজীবের অজানা ছিল ও খুব পরিচিত নাম ওদের কাছে।কিন্তু দরজার  বাইরে আটকে গেল অহনার কটা কথা শুনে।তারপরও অদৃশ্য জাদুবলে কেউ যেন ওর পা দুটো ওখানেই আটকে দিলো।না চাইতেও ওর কানে আসতে লাগলো অহনার রোজনামচা।আর পারলো না সহ্য করতে যখন শুনলো ওর স্বামী ওর কবিতার ডাইরি পুড়িয়ে দিয়েছে।ঘেন্না হতে লাগলো ওর..ওর নিজের প্রতি ঘেন্না।নিজের ইগো ভেঙে সেদিন ওর সাথে আর দেখা না করার জন্যে ঘেন্না..স্বার্থপরের মতো অর্থহীন ভালোবাসাকে যত্ন করে রক্ত মাংসের মানুষটা কেমন আছে জানতে না চাওয়ার ঘেন্না…সর্বোপরি নিজের চরিত্রটা কে কলঙ্কমুক্ত রেখে মহান থাকার চেষ্টা করার ঘেন্না।’না,এবার ও কিছুতেই ভুল করবে না।আর অহনা কে কষ্ট পেতে দেবেনা।আর কিছুর পরোয়া ও করবেনা।’…কিন্তু আবারও, আরো একবার রাজীব একই ভুল করে।নিজের মনে সাজাতে থাকে মায়ার সংসার,যেখানে কত্রীর ইচ্ছা ছাড়া কর্ম সম্ভব কিনা ভাবেওনা।আবার হয়তো একটা আঘাতের সূচনা ও নিজেই করে,যার ফল কি হবে ভাবেনা।ও ঠিক করে অহনার বৌদি চলে গেলেই ও গিয়ে অহনার সাথে কথা বলবে।অসুখী দাম্পত্য ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাওয়া একজনের কাছে হাত পেতে দাঁড়াবে প্রেমে পূর্ণতা না পাওয়া অপর একজন,যাদের জীবনের আনন্দটুকু,বেঁচে থাকার রসদটুকুও হয়তো একে অপরকে নির্ভর করেই আছে।অপেক্ষা করতে থাকে রাজীব,ডক্টর রাজীব বোস।

You may also like

2 comments

Anonymous August 26, 2021 - 8:02 PM

Very nice one

Reply
Tamali August 27, 2021 - 7:11 PM

Thank you.

Reply

Leave a Comment

error: Content is protected !!