ভালোবাসা মন্দবাসা – দশম পর্ব

by Tamali
দশম পর্ব:-
“এটা কেন করলে? তুমি তো আমায় ভালোবাসো না।নিজের স্বার্থে আর আমার ওপর জোর ফলাতে বিয়ের নাটকটা করেছ,তাহলে আজকের এই নাটকটা কেন?” অমৃতা এই প্রথম এত চেঁচিয়ে কথা বলে সৃজিতের সাথে।
মানস বেরিয়ে যেতেই সৃজিত অমৃতাকে ঘরের দরজা বন্ধ করতে বলে। দরজা বন্ধ করে তাতে পিঠ ঠেকিয়েই চিৎকার করে ওঠে ও।
সৃজিত অমৃতার কাছে এধরণের কথা আশা করেনি,ফলে শুধু চমকে যায়না,ওর নিজের বলতে চাওয়া কথাগুলোও হঠাৎ যেন এলোমেলো হয়ে পড়ে।
“কী করে বুঝলে আমি তোমায় ভালোবাসি না? আর স্বার্থ দেখলে তো শুধু কন্ট্রাক্ট করতাম,তার সাথে ম্যারেজটা জুড়লাম কেন?” যেন নিজেকেই প্রশ্ন করে ও।
“কারণ শুধু কন্ট্রাক্ট এ যে টা তোমার আসল সমস্যা,রাতে একা থাকা সেটা রয়েই যেত। তাছাড়া মাসে মাসে টাকাটা দিতে হত। এখন আমি ডিভোর্সের পর টাকা পেলেও সেটা সময় সাপেক্ষ”,আজ যেন অমৃতা বাঁধনছাড়া হয়ে গেছে।
চুপ করে বসে থাকে সৃজিত।মনেহয় হঠাৎ যেন ধরা পড়ে গেছে, কোনো উত্তর দেয়না।
“কী হলো চুপ করে আছো কেন? আমি জানি কন্ট্রাক্ট ম্যারেজেরও কোনো আইনি স্বীকৃতি নেই আমাদের দেশে।সব টা জেনেও সেদিন নিজের আশ্রয়,চাকরি বাঁচাতে আমি রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু জানতাম কন্ট্রাক্ট অনুযায়ী আমি সরকারী চাকরি পেলে এখান থেকে মুক্ত হয়ে যাবো। আর নিজের দায়িত্বটাও মাঝ পথে ছাড়তে চাইনি। তুমি জানো অনেক খারাপ কথা শুনেছি আমি অনেকের কাছে এর জন্যে। নিজেও জানিনা শুধুমাত্র চাকরি বাঁচাতে কেন সেদিন রাজি হয়েছিলাম।কিন্তু বিশ্বাস করো ভাবিনি সময় আসলে এরকম নাটক করে তুমি আমায় ফাঁসাতে চাইবে। কিন্তু কেন,কেন এমন করলে?” হাঁফিয়ে যায় অমৃতা উত্তেজনায়।
“ভয় পেয়ে,রাগে,অসহায় হয়ে”,শান্ত স্বরে জবাব দেয় সৃজিত,এক অচেনা সৃজিত।
“মানে?”,অমৃতা এতটাই অবাক হয় এগিয়ে গিয়ে বাইরের কাপড়েই বসে পড়ে সৃজিতের বিছানার এক ধারে,অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ওর মুখের দিকে।
এতক্ষন মুখ নিচু করে বসে থাকা সৃজিত এবার তাকায় অমৃতার দিকে,”কলেজে পড়তে একটা সাধারণ দেখতে মেয়ে প্রপোজ করেছিল। অনেকটা বিদ্রুপ পেয়েছিল প্রত্যুত্তরে। এরপর জীবনে বার তিনেক নাম কা ওয়াস্তে প্রেম করেছি।সম্পর্ক থেকেছে পাঁচ মাস,দশ মাস,এক বছর। সম্পর্ক ভেঙে গেলে মনে হয়েছে আর না। এত ধরা বাঁধা আমার পোষাবে না। দেখতে সুন্দর বলে আরো অনেক মেয়েই জীবনে আসতে চেয়েছে,মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছি। সেদিন বসে বসে দাদার বিয়ের অ্যালবাম দেখছিলাম।আমার অনেক ফটোতে তোমায় দেখলাম।কিন্তু তোমার চোখ দু তিনটে ছবিতে খেয়াল করলাম আমার দিকে নজর করা। আচ্ছা অমৃতা তুমি বিয়েবাড়িতে আমায় খেয়াল করেছিলে তাই না?”
“হ্যাঁ দিদির একমাত্র দেওর,খেয়াল না করার কী আছে?” গলাটা একবার সামান্য কেঁপে যায় অমৃতার।
-“হুঁ বুঝলাম। তুমি বৌদিকে প্রথমে না করে দিয়েছিলে এই কাজটার জন্যে। তারপর দুদিন পর আমার অবস্থা জানতে ফোন করো, তখন বৌদির কাছে ডিটেইলস সব জেনে দুদিন পর কাজটা করবে বলো। কেন রাজি হয়েছিলে,শুধু টাকার জন্য?তোমার বয়ফ্রেন্ড সেদিন রাজি হয়েছিল?” পার্থর ছেড়ে যাওয়ার কারণ এই একমাসে জেনেছে ও অমৃতার কাছে,বন্ধুর মত গল্প করতে করতেই।
-“এসব প্রশ্নের কী মানে এখানে? আর বয়ফ্রেন্ড রাজি নাহলে করতাম না।সে নিজেই বলেছিল। কিন্তু তার জানা ছিলোনা কোনো দায়িত্ব মাঝপথে ছেড়ে দেওয়া আমার চরিত্রবিরোধী।”
-“তাই তুমি তাকেই ছেড়ে দিলে?”
-“দেখো সৃজিত ওই ঘটনার সাথে এর কোনো যোগ নেই।ওসব ফালতু কথা ছেড়ে তুমি তোমার কথা বলো।কেন এটা করলে?”
-“কারণ ভালোবেসে ফেলেছি আমি তোমায়। সেদিন থেকে ভালো লেগেছে তোমায় যেদিন আমার মুখ দেখে তুমি বুঝতে পেরেছিলে আমি বসতে চাই। আমায় যত্ন করে যেভাবে চান করাও,খাওয়াও সেটা হয়তো তোমার ডিউটি,কিন্তু আমার কাছে অনেকখানি যত্ন,ভালোবাসা। মা মারা যাওয়ার পর যা আমি কারোর কাছে পাইনি। বিশ্বাস করো,জেদ করে নিজের স্বার্থে তোমায় বিয়ে করেছিলাম। যাতে দরকার ফুরোলে ছেড়ে দিতে পারি তাই কন্ট্রাক্ট ম্যারেজের ব্যবস্থা করি। আমি হাঁটতে পেরে যাবো হয়তো আর কমাসে,বা হয়তো সারাজীবন হাঁটতে পারবো না।কিন্তু তোমার সাথে জীবন কাটানোর কথা একমাস আগেও ভাবিনি। সার্জারির দিন কেউ এলোনা, দাদাভাইও না।খুব মন খারাপ হয়েছিল।বয়স মানুষকে আবেগ প্রবন করে,সেদিন মনে হয়েছিল কারোর কাছেই আসলে আমার কোনো মূল্য নেই। কিন্তু ওটিতে ঢোকার আগে তুমি যখন হাত টা ধরলে,ভরসা দিলে,পুরো সময়টা বাইরে বসে অপেক্ষা করলে কেন জানিনা মনেহল তুমি আছো”,চুপ করে জলের বোতলের দিকে হাত বাড়ায় ও।
অমৃতা উঠে গিয়ে গ্লাসে জল ঢেলে গ্লাসটা এগিয়ে দেয়।
জল খেয়ে অমৃতাকে গ্লাস ফেরত দিয়ে সৃজিত বলে,”সেদিন আমি ওটিতে ঢোকার সময় তোমার চোখে জল দেখেছিলাম অমৃতা। কোনো নার্স তার পেশেন্টের জন্যে কাঁদে?”
“একটা সত্যি কথা বলি। দিদির বিয়েতে তোমায় দেখে ক্রাশ জন্মেছিল এটা সত্যি।তখন বয়স কম,একজন হ্যান্ডসাম ছেলেকে দেখে আমি কেন অনেকের ক্রাশ জন্মায়।কিন্তু পরিণত আমি তোমায় নিয়ে কখনও কিছু ভাবিনি,এমনকি পার্থ চলে যাওয়ার পরও না,আজও না। নিজের জীবনের লড়াই আমায় আরো পরিণত করেছে।বাবা মার জন্যে জীবনে অনেক কিছু করতে চেয়েছিলাম,পারলাম না।ভাড়া বাড়িতেই তাদের জীবন শেষ হয়ে গেল। নিজের সংসার নিয়ে কখনোই আর ভাবিনা, ভাবি তাদের স্বপ্ন নিয়ে,জীবনে দাঁড়াতেই হবে।নার্স পেশেন্ট শুধু না,দুজন মানুষ পাশাপাশি থাকলেই মায়া জন্মাতে বাধ্য।শুধু মানুষ কেন বোল্টের জন্যে আমার ফিলিংগস এখন সবচেয়ে বেশি। সৃজিত একবছর আগে আমার আবেগ মরে গেছে,যেদিন পরপর দুদিনে মা বাবাকে হারাই।যাইহোক আমি এখনো বুঝতে পারিনি কেন তুমি এরকম করলে,আমায় ভালোবেসে এসব করেছ বিশ্বাস করিনা। আমি জানি তোমার এই ভালোবাসা আসলে মোহ, তোমার অসহায়তা। হাঁটতে পারলে এসব সব চলে যাবে।একটাই কারণ হতে পারে আমায় জব্দ করা।কিন্তু কী লাভ তাতে?” অমৃতা একদম শুকনো গলায় বলে।
এবার একটু হাসি ফোটে সৃজিতের ঠোঁটে,”জব্দ করতে!! হুঁ বিয়েটা জব্দ করতে হয়তো করেছিলাম,কিন্তু নিজেকে শেষ করার কথা ভাববো ওই কারণে এতোটাও বোকা আমি না। আজ আমি চাইনি তুমি পরীক্ষা দিতে যাও। কেন জানিনা মনে হয় তুমি পরীক্ষা দিলেই চাকরি পেয়ে যাবে,আমায় ছেড়ে চলে যাবে।তখন আমার কী হবে অমৃতা? আবার হয়তো কোন নার্স আসবে।কিন্তু সে কি এত যত্ন করতে পারবে? তোমার মত বন্ধু হতে পারবে,একমাত্র বন্ধু আমার? সারাদিন প্রায় চার দেয়ালে বন্দি আমি।জানি হাঁটতে না পারলেও আস্তে আস্তে হুইল চেয়ারে করেই সব কাজের অভ্যেস করতে হবে।আবার এটাও জানি আমার জীবন অনেক বদলে যাবে।জানো অমৃতা,আমার অবস্থা অনেকটা সেই রাখালের মত,রোজ মিথ্যে বলে বলে যেদিন সত্যি বাঘ পড়লো কেউ বিশ্বাস করলো না। আমি জানতাম না ভালোবাসার জন্যে সুন্দর শরীর না,সুন্দর মনের দরকার।তুমিই সেটা শেখালে।… ছাড়ো। আমি আজ ভুল করে ফেলেছি সাময়িক উত্তেজনায়,বা অসহায় মনোভাব থেকে। তুমি এসব ভেবোনা। তোমার পরীক্ষা নিশ্চই ভালো হয়েছে। যাও ফ্রেস হয়ে রেস্ট নাও। তুমি যেদিন চাইবে আমি তোমায় মুক্ত করে দেব।আর টাকা পয়সা নিয়ে ভেবোনা,আমি আছি যখন”,সৃজিত মাথা হেলিয়ে দেয়।
অমৃতা ওর মুখের দিকে অনেক্ষন তাকিয়ে থাকে,তারপর আর কথা বলতে ইচ্ছে করেনা।বেরিয়ে যায় ও দরজা খুলে।
সৃজিত চোখটা খুলে শুধু ওর চলে যাওয়া দেখে,তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
জীবনে প্রথমবার ও সত্যি বললো কোনো মেয়েকে,কিন্তু সে বিশ্বাস করলো না। অমৃতাকে ভালোবাসে এটাই তো ও বুঝতে পারলো কাল রাতে। হঠাৎ যখন মনে হলো ও আর মাস দুই পর চলে যাবে, বুকের মধ্যে অসহ্য একটা কষ্ট হতে লাগলো। ওকে তো ওর ফিজিওথেরাপিস্ট বলেছে ঠিক করে ওর কথা শুনে চললে একমাসের মধ্যে ও উঠে দাঁড়াতে পারবে,হাঁটতেও পারবে খুব তাড়াতাড়ি। তাহলে অমৃতা চলে যাবে ভেবে কেন কষ্ট হচ্ছিল ওর?
ওর যা অবস্থা চাইলেই ও সুস্থ হওয়ার পর সেটল হতে পারবে। কিন্তু ওই মেয়েটার জন্যে ভাবার তো কেউ নেই।সরকারি চাকরি কি পারবে সৃজিতের দেওয়া এই বিয়ে বিয়ে খেলার চিহ্ন গুলো মুছে দিতে? অমৃতা তো বিবাহিত দের মত সমস্ত চিহ্ন ধারণ করেছে।তাহলে?
আর অমৃতার মত ভালোবাসতে সত্যি কি কেউ পারবে? ও স্বীকার না করলেও ও যে ভালোবাসে সৃজিতকে,সৃজিত সেটা জানে।
একদিন হসপিটাল থেকে ফেরার পর রাতে ওর জ্বর এসেছিল,সারারাত নিজের পড়া ঘুম সমস্ত কিছু ছেড়ে অমৃতা বসেছিল ওর পাশে। একজন নার্সের সেবা করছে না ভালোবেসে দায়িত্ব পালন সেটা না বোঝার মত বোকা ও না। তবে জোর করে আটকে রেখে কারোর কিছুই ভালো হবেনা সৃজিত জানে।
একটা অ্যাকসিডেন্ট ওকে প্রাণে মারলো না,কিন্তু ওর ভেতরটা যেন বদলে দিলো। একটা বাস্তবের মুখোমুখি এনে ওকে অনেক কিছু শিখিয়ে দিলো।
নাহ, ওকে এই দুমাসের মধ্যে সুস্থ হয়ে হাঁটতে হবেই। নাহলে ওকে যদি দয়া করে অমৃতা থেকে যায়,ও কখনো তা মানতে পারবে না। অমৃতা কে মুক্তি দিতে,ওর মনের মত ওকে বাঁচতে দিতে নিজেকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে ফেলতেই হবে ওকে। ও দুর্বল না। ভালোবাসা বরঞ্চ ওকে আরো শক্তি দেবে। সুস্থ হয়ে ও অপেক্ষা করবে অমৃতা যদি কখনো ওকে ভালোবেসে ফিরে আসে। ততদিন নাহয় নিজের মন্দবাসার জন্যে প্রায়শ্চিত্ত করে অমৃতার মন্দবাসা নিয়েই ও জীবন এগিয়ে নিয়ে যাবে।
ক্রমশ…

You may also like

Leave a Comment

error: Content is protected !!