ভালোবাসা মন্দবাসা-দ্বিতীয় পর্ব

by Tamali

“মিস্টার রজত রায়?” নার্সের ডাকে ওয়েটিং রুমের চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে যাই রজত,”আপনাদের পেশেন্টের জ্ঞান এসেছে। ডক্টর বললেন ভয় কেটে গেছে।একজন গিয়ে জাস্ট দেখে আসুন।কিন্তু কথা বেশি বলবেন না”,নার্স অভ্যস্ত স্বরে কথাগুলো বলে চলে যায়।
মানসের ইশারায় রজত এগিয়ে যায় ভাইয়ের কেবিনের দিকে। প্রিয়া আজ আসেনি,বললো কী যেন কাজ আছে।

“সুজু…সুজু…আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস?” নিজের ভাইকে ছোট থেকেই এই নামে ডাকে ও।
অনেক কষ্টে আধ বোজা চোখে তাকায় সৃজিত,বুঝতে চেষ্টা করে সত্যি ওর দাদাভাই কী না? একটু হালকা হাসি ফোটে ঠোঁটে। ঢোঁক গেলে। অস্ফুটে বলে,”জ-ল”।
স্যালাইন চলছে,জল দেওয়া যাবে না। কিন্তু দেখতে পায় ভাইয়ের ঠোঁট অবধি শুকিয়ে গেছে। পাশের বেডসাইড টেবিলে নজরে আসে স্টেরিলাইজড গজ আর সিলড মিনারেল ওয়াটারের বোতল।
গজটা বোতলের জলে ভিজিয়ে সৃজিতের ঠোঁটে বোলাতে বোলাতে বলে,”স্যালাইন চলছে ভাই,নার্সকে জিজ্ঞেস না করে জল দিতে পারবো না রে। এখন কেমন লাগছে সুজু?”
কোনো উত্তর আসেনা। রজত বুঝতে পারে সৃজিতের পক্ষে এই মুহূর্তে কথা বলা সম্ভব না।
ঠিক সেই মুহূর্তে নার্স এসে ঢোকে।
-“কী করছেন আপনি?”
-“ওর ঠোঁট অবধি শুকিয়ে গিয়েছিল। জল চাইছিল,তাই ঠোঁটটা একটু জল দিয়ে মুছে দিচ্ছিলাম”।
-“এক ঢোঁক জল দিতে পারেন।আচ্ছা দাঁড়ান,আমি দিচ্ছি”।
নার্স এগিয়ে আসেন।
রজতের খুব ইচ্ছে করে ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে,কিন্তু একে মাথা জোড়া ব্যান্ডেজ তারওপর এই মুহূর্তে গায়ে হাত দেওয়া ঠিক হবে কী না বুঝতে পারেনা।
মনটা হঠাৎ খুব খারাপ হয়ে যায় ওর। ছোট থেকে ওদের দুই ভাইয়ের মধ্যে টান সেভাবে বাড়াবাড়ি রকমের ছিলনা। রজত পরিবার প্রিয় হলেও সৃজিত প্রথম থেকেই একটু উড়ুউড়ু ধরনের। যখন ছোট ছিল,তখন থেকেই বাড়ির মধ্যে থেকে পাড়ায় ওর চাহিদা বেশি ছিল। তাই ছোট ছেলে হলেও বখে যেতে ও বেশি সময় নেয়নি।
ভাইয়ের অ্যাকসিডেন্ট শোনার পর এই প্রথম ভাইকে দেখে বেরোনোর সময় রজতের চোখ সজল হয়ে উঠলো। ভাইয়ের জন্য হুহু করে উঠলো বুকের ভিতরটা। কেবিনের বাইরে এসে পেতে রাখা স্টিলের চেয়ারের একটায় বসে পড়লো । আজ বড্ড ছোটবেলাটা ফিরে ফিরে আসছে রজতের মনে।
এই দুদিন আইটিইউ’র বাইরে থেকে দূর থেকে দেখছিল ওকে। আজ কাছ থেকে দেখে বুঝলো জাস্ট মৃত্যু ছুঁয়ে গেছে ওর একমাত্র ভাইকে। কতদিন লাগবে সেরে উঠতে কে জানে! ওর এখন সবচেয়ে বড় চিন্তা কে দেখবে ওর ভাইকে। ওদের পক্ষে তো বেশিদিন এই শহরে পড়ে থাকা সম্ভব না। আর বাড়ির কাজের লোক বা ট্রেইন্ড নার্সের ওপরও ভরসা করা সম্ভব না। আর কাজের লোক বলতে বেহালার পৈতৃক ভিটেতে আছে ঠিকে কাজের এক মাসি,সেই রান্না করে দেয় দুবেলা আর অল্প বয়সী সারাদিনের একটা ছেলে। সুতরাং ব্যবস্থা একটা কিছু করতেই হবে বুঝতে পারে ও। বিশ্বাসী ট্রেইনড কাউকে পাওয়াও মুশকিল। চিন্তায় ভ্রু কুঁচকে যায় ওর।

“সরি সরি রে একটু দেরি হয়ে গেল।অনেক্ষন অপেক্ষা করছিস?” প্রিয়া কলকাতার এক বিখ্যাত মলের কফি শপে এসে যখন পৌঁছলো তখন ঘড়িতে বিকেল চারটে বাজে। ওর মাসতুতো বোন অমৃতা কে আজ দেখা করার জন্যে ডেকেছিল ও। ওকে বলেছিল সাড়ে তিনটের মধ্যে ঢুকে পড়বে,কিন্তু এই দুপুরবেলা এত জ্যাম হবে ও বুঝতে পারেনি।
“না ঠিক আছে দিদিভাই। আমিও টাইমে ঢুকতে পারিনি। তিনটে নার্সিংহোম থেকে বেরিয়ে পড়বো ভেবেছিলাম কিন্তু লাস্ট মোমেন্টে একটা কমপ্লিকেটেড কেস এসে গেল এমন…তুমি মুম্বাই থেকে কবে এলে? আর আমার ফোন নম্বর পেলে কার কাছে?” অমৃতা কিছুটা কৌতূহলী হয়েই এসেছে। যে দিদির সাথে শেষ দেখা দিদির বিয়েতে,তার হঠাৎ ওকে কী এমন দরকার পড়লো যে এরকম বিখ্যাত কফি শপে ডেকে পাঠালো,তাও ওর সুবিধার জন্য একদম ওর নার্সিং হোমের কাছে।
“আগে বল তুই কি নিবি? এখানকার কফি উইথ চকোলেটটা মন্দ না,তবে কোল্ড কফিটা বেস্ট। এবার তুই বল কী ট্রাই করবি?” প্রিয়া স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা বোনের সাথে। আজ ওর নিজের দরকার,তাই সবার আগে ওকে বোনের মন জয় করতে হবে।
“দিদিভাই আমি কিছু খাবো না,নার্সিংহোম থেকে বাড়ি গিয়ে ফ্রেশ না হয়ে কিছু খেতে ইচ্ছে করেনা। এমনকি এক কাপ চা ও না”,অমৃতা একটু জোর দিয়েই বলে।
প্রিয়া জানে অমৃতার পার্সোনালিটি বেশি। ও চাইলেও অমৃতা এতদিন পর ওর সাথে প্রথমেই খুব স্বাভাবিক হতে পারবে না। তাও একটা শেষ চেষ্টা করে,”দেখ তোর সাথে আমার বেশ কিছু গুরত্বপূর্ণ কথা আছে,সময় লাগবে। কিছু তো নিতেই হবে,নাহলে এখানে অতক্ষণ বসা এরা অ্যালাও করবে না। আমি একটা ব্ল্যাক কফি নেব,তুই বল”।
“ঠিক আছে আমার একটা কোল্ড কফি বলো তাহলে”,অমৃতা ভাবতে থাকে কী এমন কথা আছে ওর দিদির ওর সাথে।
অর্ডার দিয়ে আর সময় নস্ট করেনা প্রিয়া,”দেখ অমৃতা আমার একজন চব্বিশ ঘণ্টার ট্রেইনড নার্স দরকার। আমার দেওরের খুব বড় একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। জাস্ট বেঁচে গেছে বলতে পারিস। আজ আমার হসপিটালে যাওয়া হয়নি। কাল অবধি জ্ঞান আসেনি। তবে আমি জানি ও বেঁচে যাবে। কিন্তু এখানে বাড়িতে ওকে দেখাশোনার কেউ নেই। ও যাবে কি না জানিনা,কিন্তু ওকে আমি মুম্বাই নিয়ে যাবো না। তার জন্যে সবার আগে এখানে ওর দেখা শোনার ব্যবস্থা করতে হবে। তুই তো জানিস আমার শ্বশুরবাড়ির অবস্থা,টাকা পয়সার কোনো অভাব নেই। যাকে তাকে ওখানে আমরা ঢোকাতে পারবো না বিশ্বাস করে। তুই নার্সিং হোমে যা স্যালারি পাস আমি তার থেকেও দশ হাজার বেশি দেব। থাকা খাওয়া ফ্রি। বিকেলে যে কোনো একদিন কয়েক ঘণ্টার জন্যে বাড়ি যেতে পারবি। একটাই শর্ত সৃজিত যতদিন না সুস্থ হয়, ওর আর বাড়ির দায়িত্ব নিতে হবে। তবে হ্যাঁ পুরো ব্যাপারটা ফাইনাল হবে ও কী অবস্থায় হসপিটাল থেকে মুক্তি পাচ্ছে তার ওপর”,একটানা কথাগুলো বলে প্রিয়া অমৃতার মুখের দিকে তাকিয়ে।

পুরো বিষয়টা পরিষ্কার হয় এবার অমৃতার কাছে। কয়েক মিনিট সময় নেয় ও। তারপর বলে,”দিভাই আমি কাউকে ব্যবস্থা তো করতে পারবো না। আর আমি নিজে এধরনের কাজ করিনা। আমি সরকারি পরীক্ষার প্রিপারেশন নিচ্ছি।”
একটু থমকায় প্রিয়া।ও ভাবেনি ওর বোন প্রথমেই ব্যাপারটা না করে দেবে।ও কালকেই মায়ের কাছে শুনেছে মহামারীতে মাসী মেসো একসাথে চলে যাওয়ার পর অমৃতা ওর কাকার বাড়িতে থাকে। ওর বিয়ে নিয়ে মাথা ঘামানোর কেউ নেই। নার্সিং হোমে চাকরি করে ও যা উপায় করে তার থেকে কাকা কাকিমার সংসারে থেকে নিজের খরচ দিতে হয়। প্রিয়ার সাথে যোগাযোগ না থাকলেও ওর মা নিজের বোন মারা যাওয়ার পর থেকে তার মেয়ের খবর ঠিকই রাখে।
একটু থেমে কথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে আবার মুখ খোলে প্রিয়া,”দেখ অমৃতা আমার দেওর এমনি একটু উড়নচন্ডী ধরনের। আর ওর সব রকম গুন আছে। একদম শয্যাশায়ী বলেই তোকে ওর দায়িত্ব দেওয়ার কথা আমি ভেবেছি। নাহলে কেউ নিজের বোনকে ওর কাছে পাঠাতে ভরসা পাবে না। কিন্তু মনের দিক দিয়ে ও আবার খুব সাচ্চা,পরিষ্কার।কোনো চালাক কেউ এলে ওকে বোকা বানিয়ে অনেক কিছু সুযোগ নিতে পারে। তোর যে স্যালারি তুই পুরোটা সেভ করতে পারবি। আর যেহেতু জার্নি নেই তুই নিজের পড়ার অনেক বেশি সময় পাবি। আমার কাজটা তো পার্মানেন্ট না। ডাক্তারের হিসেব অনুযায়ী মিনিমাম চার থেকে ছমাস লাগবেই। সুতরাং ভেবে দেখ,এখানে তোর লাভ বই ক্ষতি কিছু নেই। উল্টে স্বাধীন ভাবে থাকতে পারবি। এই কাজ শেষ হলে যদি সরকারি চাকরির পরীক্ষা তথনও না হয় আমি তোকে প্রাইভেট চাকরি পেতে সাহায্য করবো। এবার তুই ভাব…”,ওদের কফি এসে যাওয়ায় চুপ করে প্রিয়া।
ওয়েটার চলে যেতে অমৃতা এবার কথা বলে,”বুঝলাম দিভাই।আমায় দুদিন সময় দাও।একটু ভেবে তোমায় জানাবো।আসলে মাসীমণি সবটা জানে আমি কিভাবে সব কিছু ম্যানেজ করছি। আর এই নার্সিংহোমে রুলস আছে কিছু। ছাড়ার আগে নোটিশ দিতে হয়,অন্তত দশদিনের।আর তারপর টাকা পেতে কালঘাম ছোটে। এমাসের চারদিন গেলে ও মাসের দুতিন তারিখে স্যালারি পাবো,তারপর আমি নোটিশ দিতে পারবো। সেই কদিন একটু ভাবি। তারপর তোমায় জানাবো। এবছর আমায় কোনো না কোনো ভাবে গভর্নমেন্ট জব গাঁথতেই হবে। এভাবে নাহলে আমার পুরো জীবন শেষ হয়ে যাবে। জানোই তো যার বাবা মা নেই,তার জন্যে ভাবার কেউ নেই”,হতাশা আর ধরে রাখতে পারেনা ও।
কাকিমার এমনি সব ভালো। ও একজনের তুলনায় একটু বেশিই টাকা দেয় সংসারে,তাও কাকিমা এক্সপেক্ট করে ও সংসারের কাজেও সাহায্য করবে। ফলে পড়াশোনা আজকাল একদমই হয়না। প্রিয়ার দেওয়া অফার সেক্ষেত্রে ওর কাছে হাতে চাঁদ পাওয়ার মত।প্রথমে ‘দিদির শ্বশুরবাড়ি নার্সের কাজ করবো ‘ ভাবলেও পরে প্রিয়ার কথা ঠান্ডা মাথায় শুনে ও বুঝতে পারে এতে ওর সব দিক দিয়ে লাভ। আর ভালো মানুষ বা মন্দ পুরুষ সবই ওর দেখা হয়ে গেছে দুবছরের কাজের জীবনে। সেই নিয়ে ও ভয় পায়না। আর ওর দিদির দেওর কে ও দেখেছে। দিদির বিয়ের সময় ওর দিকে ফিরেও দেখেনি,এতটাই তার রূপের অহংকার। ওর মত সাধারণ দেখতে মেয়েদের এই ধরনের নাক উঁচু ছেলেদের নিয়ে চাপ নেওয়ার দরকার হয়না।
“আমি তোর ফোনের অপেক্ষা করবো। আর দিন তিনেক আমি থাকতে পারবো। তার মধ্যে মন ঠিক করতে পারলে আমি নিজেই তোকে সবটা বুঝিয়ে দিয়ে যেতে পারতাম।কিন্তু তাড়া কিছু নেই,তুই সময় নে”,কথা শেষ করে নিজের কাপ চুমুক দেয় প্রিয়া।
আর অমৃতা কোল্ড কফি গ্লাসে স্ট্র ঘোরাতে ঘোরাতে বলে,”হুঁ আমি ফোন করবো যত তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিতে পারি”। ওর চোখে পড়েনা মুম্বাইয়ের বিখ্যাত মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির এইচ আর প্রিয়া রায়ের চোখের আত্মবিশ্বাসটা। প্রিয়া বুঝতে পারে ও নিজের টার্গেট বশ করে ফেলেছে। এবার শুধুই অপেক্ষা।

ক্রমশ…

You may also like

Leave a Comment

error: Content is protected !!