ভালোবাসা মন্দবাসা – নবম পর্ব

by Tamali
নবম পর্ব:-
অমৃতা চুপচাপ নিজের ঘরে বসে বসে ভাবছে শেষ প্রায় চারমাসে ওর জীবনটা কেমন যেন ওলটপালট হয়ে গেল। না সেদিন প্রিয়া দিদির কথায় ও রাজি হত,না এমন একটা অস্বাভাবিক জীবনে এসে পড়তো। পার্থর সাথে সম্পর্ক শেষ হওয়ার পরও ও সমানে ফোন করার চেষ্টা করে। বারবার অমৃতা ফোন কাটে, বারবার ও রিং করে। অমৃতা জানে ফোন ধরলে পার্থ ভালো কিছু বলবে না,উল্টে ওর কাজের জন্য যা তা শোনাবে। এতদিনে তো বিয়ের খবরও পেয়ে গেছে। গায়ের ঝাল মেটাবে বলেই ও ফোন করছে এ ব্যাপারে অমৃতার কোনো সন্দেহ নেই।
কাল ওর সরকারী চাকরির পরীক্ষা,এতদিন ধরে যে দিনটার জন্যে ও অপেক্ষা করে আছে সেই দিনটা। ওর প্রিপারেশন নিয়েও খুশি।শেষ পাঁচমাসে আর যাই খারাপ হোক,সেটা ও ভুলে যেতে পারে যদি এই চাকরিটা পায়।কিন্তু বিধি বাম,আজ সকাল থেকে সৃজিতের মাথায় অসহ্য ব্যাথা হচ্ছে।পায়েরও সেভাবে সার পাচ্ছে না।দিন পাঁচ আগে বাড়ি এসেছে ও।কাল বিকেলেও  যথেষ্ট সুস্থ ছিল,সন্ধেবেলা ওর সাথে গল্পও করলো।রাতে যখন ও ঘুমোয় তারপর অমৃতা নিজের ঘরে চলে এসেছিল শেষ মুহূর্তের প্রিপারেশন ঝালাবে বলে,কিন্তু ঘন্টা খানেক পরে বেল দিয়ে সৃজিত সবাইকে ঘুম থেকে তুলে দেয়।
ও নিজের ঘরে পড়ছিল বলে অনেক বুঝিয়ে ঘুম পাড়ালেও আজ সকাল থেকে শুরু হয়েছে শরীরের সমস্যা।
রতন বলেছিল আবার হসপিটালে যাওয়ার জন্যে,কিন্তু তাতে সৃজিত যেরকম মারমূর্তি ধারণ করে রতন আর সারাদিন আশেপাশে ঘেঁসেনি।
সবচেয়ে যন্ত্রনা হয়েছে অমৃতার,না সৃজিত ডাক্তারকে কল করতে দিচ্ছে,না ওষুধ খাচ্ছে।শুধু অমৃতাকে ছাড়ছে না। চান করার নাম করে ও নিজের ঘরে এসে একটু বসেছে সবেমাত্র,আবার একটানা বেলের আওয়াজ…
বড্ড ক্লান্ত লাগে ওর। নার্সরাও তো মানুষ,তাদেরও তো শরীর খারাপ হতে পারে,আর ইচ্ছে করেনা এভাবে জীবনটা কাটাতে। কিন্তু ও বাধ্য। নিজে জানেওনা এর শেষ কোথায়। অদ্ভুত এক নেশায় ও নিজেও যেন ছুটে চলেছে। কন্ট্রাক্ট সই করার পর সৃজিত ওকে স্যালারির ব্যাপারে এই দুমাস কিছু বলেওনি,আর ও নিজেও জানেনা কী বলবে এটা নিয়ে। ভেবেছিল কাল পরীক্ষা দিয়ে এসে কথা বলবে,কারণ ওর কাছে এই বিয়েটাই তো বিয়ে না।আসলে ওর জীবন পুরো ঘেঁটে গেছে। ও নিজেও জানেনা কীভাবে এটা গুছোবে।
উঠে পড়ে নিজের এক চিলতে ঘরের চেয়ার ছেড়ে,এটাই এখনো এই বাড়িতে ওর নিজের ঘর,পা বাড়ায় সৃজিতের ঘরের দিকে।কিছু একটা ব্যবস্থা ওকে করতেই হবে।
-“তুমি এই অবস্থায় আমায় রেখে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছো? কোনো ইমার্জেন্সি হলে?”
-“কোনো ইমার্জেন্সি হবে না। হলেও রতন কে সব বোঝানো আছে।আর মানসদা কে রজতদা ফোনে বলে রেখেছে,আর রতনের কাছে নম্বর আছে।এইটুকু সময় ওরা সামলে দিতে পারবে”।
-“অমৃতা!! তুমি দাদা কে ফোন করেছিলে??”
-“হ্যাঁ,কাল রাতে। এছাড়া আমার হাতে অন্য কোনো অপশন ছিলোনা।”
-“তুমি একবারও আমায় জিজ্ঞেস করলে না?”
-“না,কারণ আমায় হায়ার করে প্রিয়াদি। ও জানতো এই পরীক্ষাটা কতটা ইম্পরট্যান্ট আমার কাছে।”
-“তুমি এখন এমপ্লয়ী না,তুমি এবাড়ির বউ”।
-“দেখো সৃজিত আমি ঠিক কী এবাড়িতে আমি সব জানি।আমি যেটা করছি সেটাও আসলে একটা চাকরি। বদলে আমি জাস্ট কিছুই পাচ্ছিনা। ছাড়ো, তুমি রেস্ট নাও।ফিরে কথা হবে”।
-“না ফিরে নয় এক্ষুনি কথা হবে”।
এবার অমৃতার অবাক লাগে। তাহলে কী সত্যি সৃজিত আমায় পরীক্ষা দিতে যেতে দেবে না বলে এটা করছে? কিন্তু এতে ওর স্বার্থ!! ও কয়েক সেকেন্ড ভাবে…
“না আমার দেরি হচ্ছে।আমি এলাম।বিকেলের মধ্যে ফিরে পড়বো”,আর সৃজিত কে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে যায় ও।শুনতে পায় সৃজিত চেঁচিয়ে কিছু বলছে,কিন্তু মন না দেওয়ায় বুঝতে পারেনা কথাগুলো।
কাল রাতে রজতকে যখন ফোন করে প্রথমবারেই ফোন ধরেনি ও। বাধ্য হয়ে দুবার চেষ্টা করার পর অমৃতা মেসেজ করেছিল। মেসেজে আকুলভাবে অনুরোধ করেছিল একবার ফোন করার। দশমিনিট পর ফোন আসে।
-“বলো,কী দরকার?সুজু ঠিক আছে?”
-“না,ওই জন্যেই ফোন করছিলাম।”
-“কেন? কি হলো আবার?” রজতের গলার উৎকণ্ঠা বুঝিয়ে দেয় দাদা এখনো ভাইয়ের জন্যে উদ্বিগ্ন। শুধু অভিমানের জন্যে আসেনি। তবে সৃজিতের অপারেশনের পরের দিন ওর মাসতুতো দাদা মানস এসেছিল,সেটা হয়তো রজতের অনুরোধেই। সেও একটাও কথা বলেনি অমৃতার সাথে।
অমৃতা সব কিছু খুলে বলে রজতকে,এমনকি কন্ট্রাক্ট ম্যারেজের কথাও বাদ যায়না। শুনে প্রথমে বিশ্বাস করতে না পারলেও নিজের ভাইকে চেনে বলে পরে রজত সবটা বিশ্বাস করে। অমৃতার পরীক্ষার কথা শুনে হঠাৎ ওর মনেহয় হয়তো সৃজিত নাটক করছে অমৃতা কে আটকাতে। ছোটবেলায় শরীর খারাপ থাকলে রজতকে স্কুল যেতে দিতে চাইতো না ও,আর ওর বাবা কে অফিস।
তারপর মানসকে ফোন করে সমস্ত ব্যবস্থা করে রজত রাতেই।
অমৃতা জানেনা ওর আর সৃজিতের সম্পর্ক ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে!শুধু জানে সৃজিতকে এই মুহূর্তে ও কোনো ভরসা করতে পারবে না। সৃজিত কী ভাবছে সেটা নাকি ওর ছায়াও জানতে পারেনা। আজ অবধি ও অমৃতার হাতটা অবধি ছুঁয়ে দেখেনি।ওর চোখে অমৃতা অন্তত কোনো ভালোবাসা দেখেনি। উল্টে ওর মনে হয়েছে সৃজিত অধিকার ফলানো একটা ছেলে,সমস্ত নিজের কন্ট্রোলে রাখতে ভালোবাসে।
একদিন পর্রীক্ষা করার জন্যই সৃজিতের ঠোঁটে ঠোঁট ঠেকানোর নাটক করতে গিয়েছিল ও,কিন্তু সৃজিত মুখ সরিয়ে নেয়। ওর অস্বস্তি বুঝিয়ে দেয় ও অমৃতাকে বউ বানালেও মনের দিক থেকে এখন তৈরি না।
সৃজিতের সম্বন্ধে প্রিয়া যেমন বলেছিল ওর পক্ষে এক বিছানায় শুয়ে,বা এক ঘরে রাত কাটিয়ে মেয়েদের সংস্পর্শে না আসা কোনোভাবেই সম্ভব না। কিন্তু একটাই শর্ত সৃজিত রায়ের শয্যা সঙ্গিনী হওয়ার জন্য ‘অপূর্ব সুন্দরী হতে হবে সেই মেয়েকে’,প্রিয়া বলেছিল। ‘দেখতে সাধারণ মেয়েদের,বিশেষ করে কালো মেয়েদের ছুঁতে ওর ঘেন্না করে’।
অমৃতা সবটা বুঝেও শুধু নিজের স্বার্থে আছে বা বিয়েটা করেছে। সৃজিতের এই আবেগ যে ভালোবাসা নাহয়ে নিজের স্বার্থে মন্দবাসা হতেও পারে সেটা অমৃতা ভালোই জানে। তাই হয়তো নিজের দুর্বলতা কাটিয়ে আজ ও পরীক্ষার জন্যে বেরিয়ে আসতে পারলো।
পরীক্ষা শেষে বাইরে বেরিয়ে মোবাইলটা অন করে অমৃতা। সৃজিতের ভয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েই অফ করে দিয়েছিল ফোনটা। কিন্তু সারাদিন সৃজিতের কোনো খোঁজ নেওয়া হয়নি…ফোন করলো সৃজিতের নম্বরেই। আর একটুও আশ্চর্য্য হলোনা,ফোন বেজে গেল সৃজিত ধরলো না। ও এটাই আশা করেছিল। ওর পরীক্ষার সেন্টার খুব একটা দূরে না,কী ভেবে প্রাইভেট ক্যাব ভাড়া করে নিলো একটা। বাড়ির গেটের সামনে ক্যাব থেকে নেমে যখন ক্যাশে ভাড়া দিচ্ছে দেখলো ওকে দেখেই দৌড়ে এলো সৃজিত দের দারোয়ান মনোহরদা।
কিছু একটা আন্দাজ করেই ইশারায় ওকে চুপ থাকতে বললো অমৃতা।ভাড়ার টাকা বুঝে ক্যাবটা চলে যেতে মনোহরের দিকে তাকালো অমৃতা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে।
“সব্বোনাস হয়ে গেছে দিদিমণি। তুমি চলে গেলে আর দাদাবাবু রাগ করে নিজের হাত কেটে ফেললো। কী রক্ত দিদিমণি…”,মনোহরদা কে কথা শেষ করতে না দিয়ে মাঝপথেই একটি চাপা আত্মচিৎকার করে ওঠে অমৃতা।
“কী বলছো মনোহরদা? এখন কেমন আছে তোমার দাদাবাবু? আমায় খবর দেয়নি কেন কেউ?” বিশ্বাস করতে চায়না ও নিজে।প্রায় দৌড় দেয় বাড়ির দিকে।
সৃজিতের ঘরে গিয়ে যখন থামে তখন সেখানে বসে আছে আরও একজন,মানসদা।
ওকে দেখে গম্ভীর মুখে উঠে দাঁড়ায় ও,অমৃতা বুঝতে পারে ওকে আজ কথা শুনতেই হবে।
“অমৃতা কথা আছে তোমার সাথে,পাশের ঘরে চলো”,মানস অমৃতা দরজার দিকে এগোতে যাবে চোখ বন্ধ রেখেই সৃজিত বলে,”না যা বলার এঘরে বলো”।
ঘুরে তাকায় মানস সৃজিতের দিকে।
“কী বলার জায়গা তোরা রেখেছিস বল? প্রথমে কাউকে কিছু না জানিয়ে বিয়ে করলি।তোরা যা করেছিস তা তে কি এবাড়ির সম্মান বেড়েছে বল? আত্মীয়রা রজতদা কে ফোন করে…ছাড় সেসব কথা। আচ্ছা অমৃতা তোমার এখানে রাখা হয়েছিল কী কারণে,দায়িত্ব যদি পালন করতে না পারবে নিয়েছিলে কেন? জানি তোমার কেরিয়ার ভেবে এই চাকরি নিয়েছিলে,আজকের পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ তোমার কাছে।কিন্তু তখন অবস্থা অন্য ছিল,এখন তুমি নার্স না এবাড়ির বউ,সৃজিতের বউ।তাহলে…”,একটানা এতটা বলার পরও কথা শেষ করতে পারেনা মানস,বাধা পায় সৃজিতের কাছে।
“মানসদা অমৃতার কোনো দোষ নেই।আমি ভুল করেছি। আমি অমৃতার সাথে কিছু কথা বলবো।প্লিজ যদি কিছু মনে না করো,আমাদের একটু একা কথা বলতে দাও।আর হ্যাঁ রতনের ফোন পেয়ে তুমি যে ছুটে এসেছিল ধন্যবাদ তোমাকে। তুমি তো জানোই আমি বরাবরই এরকম,বেপরোয়া জেদী স্বার্থপর।শুধু শুধু অন্য একজন কে দোষারোপ করে কী লাভ বলো? দাদাভাইকে বোলো আমি ভালো আছি।আমায় নিয়ে চিন্তা করতে হবেনা।আর আজ তুমি এসো,অমৃতার সাথে কথা বলতে আমার সময় লাগবে”,খুব কেটে কেটে ভাঙা গলায় কথাগুলো বলে সৃজিত।
মানস যদিও জানে সৃজিতকে,তাও ওই মুহূর্তে একটা তৃতীয় ব্যক্তির সামনে সৃজিতের এরকম কাঠ কাঠ কথা ওর ভালো লাগে না। মুখটা কঠিন করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় ও,অমৃতা কিছু বলার সুযোগটুকু পায়না।
ক্রমশ…

You may also like

Leave a Comment

error: Content is protected !!