সাত পাকে বাঁধা – চতুর্থ ভাগ

by Tamali


পঞ্চম পর্ব:-


“পর্ণা,এই পর্ণা।দাঁড়া একটু।”প্রজ্ঞার ডাকে ডিপার্টমেন্টের একতলার গেটে দাঁড়িয়ে পরে পর্ণা।আজ ও একা,সুশীর শরীর ভালো নয় বলে আসেনি।আর শুভ ওকে উনিভার্সিটি থেকে একটু দূরে ছেড়ে দিয়ে গাড়ি পার্ক করতে চলে গেছে।

“বল এখানে দাঁড় করালি কেন?রুমে গিয়ে কথা বলি?”পর্ণা অধৈৰ্য্য হয়।এমনিতেও এই মেয়েটাকে ও এড়িয়েই চলে একটু।

“হমম চল উঠতে উঠতে কথা বলি।…আচ্ছা, তুই তো দূর থেকে আসিস।কিসে করে আসিস রে?”প্রজ্ঞা খুব আন্তরিকতা দেখিয়ে প্রশ্নটা করে।কিন্তু আন্তরিকতাকে ছাপিয়ে যায় কৌতূহলী স্বর।পর্ণা একটু সতর্ক হয়।

“হঠাৎ আমি কিভাবে আসি জানতে চাইছিস?”উত্তর না দিয়ে উল্টে প্রশ্ন করে প্রজ্ঞা কে।

“আরে এটা তো সাধারণ প্রশ্ন।আমরা একসাথে ক্লাস করছি প্রায় একমাস হতে চলল।এখন তো সবাই সবাইকে চিনছি।তাই জিজ্ঞেস করলাম।কেন তোর বলতে আপত্তি আছে?”প্রজ্ঞা রীতিমতো তৈরি হয়ে এসেছে পর্ণা বুঝতে পারে।ও যেভাবে শুভর পিছনে পরে গেছে খুব তাড়াতাড়ি পর্ণাকে চেস করবে সেটা ওরা বুঝতেই পারছিল।

“আপত্তি আর কি?আমি আর সুশী একসাথে আসি,আজ তো…”পর্ণার কথা বাধা পায় দোতলা থেকে তিনতলায় ওঠার সিঁড়ির মুখে।দোতলার স্টাফরুম থেকে এস.এস ওকে ডেকে ওঠে ওর নাম ধরে।তারপর বেরিয়ে আসে বাইরে,”পর্ণা তুমি যে নোটটা চেক করতে দিয়েছিলে ওটা দেখা হয়ে গেছে।কিছু চেঞ্জ করেছি,দেখে যাও।”পর্ণা কে দূরে ছেড়ে শুভঙ্কর গাড়ি নিয়ে উনিভার্সিটি ঢুকে পার্ক করে আগে ডিপার্টমেন্টে চলে আসে।কিন্তু যতক্ষন না পর্ণা দোতলা দিয়ে ওপরে উঠছে ওর নজর সিঁড়ির দিকেই থাকে।প্রজ্ঞাকে ওর সাথে দেখে বুঝতে সময় লাগেনা ঘটনাটা।তাই পর্ণাকে আড়াল করতে ওকে এটুকু মিথ্যে বলতেই হয়।পর্ণা শুভর কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে প্রজ্ঞার দিকে ফিরে বলে,”তুই এগো।আমি স্যারের সাথে কথা বলে আসছি।” প্রজ্ঞার মতো মেয়েরা হয়তো সত্যি আত্মসম্মানের ধার ধারেনা অনেক সময়।তাই নির্লজ্জের মতো বলে,”চল আমিও যাই।আমারও বোঝা হয়ে যাবে।”এবার এস.এস এর গলা বদলায়,সেই পুরোনো এস.এস এর গলা অনেকদিন বাদে শোনে পর্ণা,”কি নোট তুমি জানো প্রজ্ঞা?না জেনে, বুঝবে কিকরে?…আর হ্যাঁ তোমরা এখন ভালো বন্ধু ঠিক আছে,কিন্তু পড়াশোনার ক্ষেত্রে কম্পেটিশন তো থাকবেই।তাই পর্ণার কষ্ট করে লেখা নোট তোমাকে দেখাবো এটা ভাবলেই বা কিকরে?তুমি যাও ওপরে,পর্ণার সময় লাগবে।”এস.এস এর কথায় প্রজ্ঞার মুখ ছোট হয়ে যায় অপমানে।এতক্ষন ধরে পরে থাকা সরলতার মুখোশ খুলে পর্ণার দিকে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টি হেনে ও গটগট করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায়।ওর চলে যাওয়ার দিক থেকে নজর সড়িয়ে শুভঙ্কর পর্ণাকে বলে,”ভেতরে চল।এখনো কেউ আসেনি,স্টাফরুম ফাঁকা।”শুভর কথায় পর্ণা শুভকে অনুসরণ করে।মিনিট পনেরো পর পর্ণা ওপরে উঠে দেখে ওদের ক্লাসরুমের সামনে টানা বারান্দায় প্রজ্ঞা তখনও দাঁড়িয়ে আছে।পর্ণা সোজা রুমের দিকে যেতে গেলে ও বাধা দেয়।”কিরে নোটস বোঝা হলো?এতক্ষন ধরে স্যার কি বোঝালো সত্যি জানতে খুব কৌতুহল হচ্ছে।…যাইহোক তুই কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দিসনি তখন।”এবার পর্ণা প্রজ্ঞার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়,”কি ব্যাপার বলতো!তোর কৌতূহল তো শালীনতার সীমা অতিক্রম করছে।আমার যাতায়াত নিয়ে হঠাৎ তোর এত আগ্রহ কিসের?সরি রে তোর কৌতূহল মেটাতে আমি এই মুহূর্তে পারছিনা।”বলে ওকে পেরিয়ে পর্ণা যেতে গেলে প্রজ্ঞা ওর হাত টেনে ধরে।পর্ণা এবার জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকায় ওর দিকে।প্রজ্ঞা তখন দাঁতে দাঁত চেপে কেটে কেটে বলে,”কাল তোদের আমি একটা গাড়িতে উঠতে দেখেছি ফেরার সময়।সমস্যা সেটা নয়,সমস্যা হলো দূর থেকে দেখেছি তাই শিওর নই, কিন্তু গাড়ির রংটা হুবহু এস.এস এর গাড়ির মতো।…তোর হাজব্যান্ড আশা করি জানেন যে তুই কারোর গাড়িতে বাড়ি ফিরেছিস?”প্রজ্ঞার কথা শেষ হওয়ার আগেই নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে পর্ণা ওর চোখে চোখ রেখে বলে,”তুই কি আজকাল এস.এস কে সারাক্ষন নজর বন্দি করে রাখছিস নাকি?যদি তাই হয় তোর উত্তর খুব তাড়াতাড়ি তুই নিজেই পেয়ে যাবি।আর হ্যাঁ গাড়িটা কে চালাচ্ছিলো আশা করি দেখিসনি,দেখলে এত প্রশ্ন করতে হতোনা।যাইহোক টপার হতে গেলে ইয়ং ট্যালেন্টেড স্যারের পিছন পিছন এত ঘুরতে হয় জানা ছিলোনা।”পর্ণার কথার মাঝে প্রজ্ঞা চেঁচিয়ে ওঠে,”পর্ণা…..।ডোন্ট ক্রস ইওর লিমিট”।পর্ণা হেসে ফেলে,”আমিও তোকে ওই কথাটাই এতক্ষন বোঝাতে চাইছি।আর হ্যাঁ শুধু এটুকু জেনে রাখ কাউকে পুরো না জেনে তাকে নিজের সম্পত্তি ভেবে বসিসনা।আর যাইহোক ভালোলাগানো বা ভালোবাসানো জোর করে হয়না”।বলে প্রজ্ঞার উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজেদের রুমের দিকে চলে যায়।প্রজ্ঞা চোখে একরাশ প্রতিহিংসা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে,আর মনে মনে সত্যিটা জানতে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠে।
আর কদিন পরের পুজোর ছুটি পরে যাবে,তাই সব স্যার ই নিয়মিত ক্লাস নিচ্ছেন যাতে সিলেবাস যতটা সম্ভব এগিয়ে রাখা যায়।শুভঙ্করকেও রীতিমতো বাড়িতেও পড়তে হয়,প্রথম বছর উনিভার্সিটিতে পড়াচ্ছে।আর.ডি যথেষ্ট গাইড করেন,কিন্তু এস.এস এমন একজন টিচার  যার নিজের হোমেওয়ার্ক পুরো নাহলে সেই জিনিসটা ভুলেও পড়ায়না।পর্ণার এতে সুবিধাই হয়,বাড়িতে ওকে পড়িয়ে শুভঙ্কর প্র্যাক্টিস করে আর ক্লাসে ওর সেটাই রিভিশন হয়ে যায়।

পর্ণা মাঝে দুদিনের জন্যে শনিবার রবিবার দেখে ওর বাপেরবাড়ি যায়,অনেকদিন যাওয়া হয়নি বলে।শুভ পৌঁছে দিয়ে আসতে চেয়েছিল কিন্তু পর্ণা জেদ করে নিজেই যায়,কতদিন এভাবে পাহারায় ঘুরবে ও!আধা ঘন্টারও রাস্তা নয়,আর তাছাড়া শুভর পরেরদিন দুপুরে ওখানে খাওয়ার নিমন্ত্রণ তাই আসার সময় তো একা ফিরবেনা।শনিবার সকাল সকাল চলে গিয়ে চান খাওয়া করে,সারাদুপুর মায়ের সাথে বকবক করে বেশ নিজের মেয়েবেলায় ফিরে যায়।সন্ধ্যে বেলা চা খেতে খেতে মামনির কথা মনে হতে শুভর ফোনেই ফোন করে,ভাবে দুজনের সাথেই কথা হয়ে যাবে।একবার পুরো রিং হয়ে কেটে যাওয়ার মুহূর্তে শুভঙ্কর ফোন ধরে,”বলো।”গলার আওয়াজে পর্ণা থমকে যায়,সেই পুরোনো এস.এস এর গলা।পর্ণা কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বলে,”কি করছিলে?মামনি কি করছে?”ও প্রান্তে কিছুক্ষন নীরব থাকার পর উত্তর আসে,”দাঁড়াও মা কে দিচ্ছি।”বলে পর্ণা কিছু বলার আগেই ফোন শুভ্রা দেবীকে দিয়ে দেয়।শুভ্রা দেবী কিছুক্ষন কথা বলে যখন বলেন,”ফোন রাখি তাহলে?”পর্ণা কিন্তু কিন্তু করে বলতে বাধ্য হয়,”তোমার ছেলে আছে মামনি?”

“শুভ তো আমায় ফোন ধরিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।কেন কিছু বলবি?”মামনির কথায় হতাশা গিলে পর্ণা বলে,”না থাক।কাল কখন আসতো জিজ্ঞেস করতাম।”

“আচ্ছা ও ফিরলে তোকে ফোন করতে বলছি।..”শুভ্রা দেবীকে থামিয়ে দিয়ে পর্ণা বলে ,”না থাক।তুমি শুধু বেশি দেরি করতে বারণ কোরো।”এরপর ফোন রেখে আকাশ পাতাল ভেবেও শুভর ওই গলার আওয়াজের কারণ খুঁজে পায়না,কারণ খুঁজে পায়না ওকে এড়িয়ে যাওয়ার।সকালে শুভ আসার অপেক্ষা করতে থাকে।পরেরদিন শুভকে অনেকদিন পর বড় অগোছালো লাগে।চিন্তিত পর্ণা কিন্তু কিন্তু করে আড়াল দেখে বলেই ফেলে,”কিগো শরীর খারাপ?”ভ্রু কুঁচকে তাকায় শুভ ওর দিকে,সেই কলেজের মুখের আদল দেখতে পায় পর্ণা।ভয় পেয়ে সরে যায়,’কি হলো শুভঙ্করের?’ভাবে কখন বাড়ি গিয়ে একা কথা বলবে ওর সাথে।সারা রাস্তা শুভঙ্কর শুধু চুপ করে বাইক চালায় তাই নয় বাড়ি ফিরেও এড়িয়ে থাকে পর্ণাকে।অভিমানে পর্ণার কান্না পেলেও কিছু বলার সুযোগ পায়না।রাতে মামনির হাতে হাতে সব গুছিয়ে ঘরে গিয়ে দেখে শুভ আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছে পর্ণার জায়গার দিকে পিছন করে।পর্ণা যত তাড়াতাড়ি হয় গিয়ে শুভর পাশে শুয়ে ওর পিঠে হাত রাখে।কোনো শব্দ করেনা ও।”আমি জানি তুমি ঘুমাওনি।এদিকে ফের।বলো না কি হয়েছে তোমার?কাল বিকেল থেকে কেন ওরকম অদ্ভুত ব্যবহার করছ?”পর্ণার কথার কোনো উত্তর আসেনা।কিছুক্ষন পর পর্ণা হাত সরিয়ে উল্টো দিকে মুখ করে শুয়ে পড়ে,কিন্তু ঘুম আসেনা।অকারণ শুভর এরকম ব্যবহার ওকে খুব কষ্ট দেয়,দু ফোঁটা চোখের জল বালিশে এসে পড়ে।মাঝরাতে ঘুমের ঘোরে পর্ণার দিকে ফিরে অভ্যেস বশত পর্ণার গায় হাত দিতে গিয়ে শুভ বোঝে জায়গাটা খালি।ঘুমের ঘোরে ভাবে হয়তো ওয়াশরুম গেছে,কিন্তু তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় শুয়ে থাকে।বেশ কিছুক্ষণ চোখ বুজে থাকার পর চোখ খুলে উঠে বসতে গিয়ে দেখে পর্ণা জানলার ধারে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।কিছুক্ষন চুপ করে শুয়ে ভাবে কি করবে?কারণ শুভর অভিমানটা হয়তো অনেকের কাছে অর্থহীন,এমনকি পর্ণাও হয়তো বুঝবেনা…’কেন একা বাপের বাড়ি গেল?কেন গিয়ে সারাদিন আমায় মনে পরলোনা?সারাদিন শেষে যাও বা ফোন করলো তাও মায়ের জন্যে,তারপর রাতে একবারও মনে পরলোনা?কেন বুঝতে পারলোনা আমি সারারাত ওকে জড়িয়ে ঘুমোই, আমার ঘুম আসবেনা?’….এত এত এত অভিযোগ আর অভিমান।কিন্তু সত্যি তো ও বেচারার কি দোষ?ও কিকরে বুঝবে ও এখন শুভর শুধু স্ত্রী নয়..ওর জীবন,ওর ভালোবাসা,ওর অভ্যেস,ওর অস্তিত্ব।কিন্তু পর্ণাও তো মা বাবার একমাত্র সন্তান,আর পর্ণা ছাড়া ওদেরও কত একঘেয়ে জীবন কাটে।সব বোঝে শুভ,কিন্তু এই ঘরটায় ঢুকে পর্ণাকে দেখতে না পেলে কোনো কিছু মনে থাকেনা,অভিমান ছাড়া।আর এখন তো পর্ণা ওর সবচেয়ে ভালো বন্ধু,যাকে শুভ সব না বলে শান্তি পায়না।কিন্তু…সত্যি হয়তো গাম্ভীর্যের আড়ালে ছেলেমানুষি টা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।বিছানা থেকে নেমে পর্ণার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।আস্তে করে ওর পিঠে হাত রেখে বলে,”শোবে চলো”।এক ঝটকায় ঘুরে শুভর বুকের ওপর পরে পর্ণা ফোঁপাতে লাগে,কিল মারতে থাকে ওর বুকে।শুভঙ্কর পর্ণাকে বুকে জড়িয়ে বিছানায় নিয়ে গিয়ে ওভাবেই শুয়ে পড়ে,তারপর  তীব্র আশ্লেষে পর্ণার ঠোঁটটা শুষে নিতে থাকে।বয়সের কারণের সমীহ,বয়সে অনেকটা ছোট হওয়ার জন্য স্নেহরস,যত্নের আদর সব হারিয়ে গিয়ে শুধু বেঁচে ওঠে প্রেমে সিক্ত স্বামী স্ত্রী।পাগলের মতো পর্ণাকে আঁকরাতে আঁকরাতে শুভঙ্কর ফিসফিস করে বলতে থাকে,”তোমাকে ছাড়া একদিনও আমি থাকতে পারিনা।তুমি ভাববে পাগলের প্রলাপ,হ্যাঁ আমি পাগল,পাগল তোমার জন্যে।একমুহূর্তের জন্যে তোমার আমায় ভুলে থাকা আমি নিতে পারিনা।প্লিজ কোনোদিন আমায় ফেলে যাবেনা।কথা দাও,কথা দাও পর্ণা….”।

ষষ্ঠ পর্ব:-


“মা..ম…নি… কোথায় তুমি?দরজা খুলছো?”বিয়ের পর প্রথম অষ্টমীর অঞ্জলি দিয়ে এসে পর্ণা লুচি ভাজতে ভাজতে রান্নাঘর থেকে চিৎকার করে,দরজায় কেউ বেল দিচ্ছে শুনে।শুভঙ্কর পর্ণাকে পৌঁছে দিয়ে পাড়ার প্যান্ডেলে গেছে আবার,এ’কদিন ও শুধুই শুভ হয়ে ওঠে শুভঙ্কর সেন থেকে।দুর্গাপুজো ওর এত প্রানের প্রিয় যে বছরে এইকদিন ও খোলস ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে, প্রাণচঞ্চল যুবক হয়ে যায়,যদিও পাড়ার গন্ডির মধ্যেই।”হ্যাঁ খুলছি।শুভ চলে এলো হয়তো।”বলে দরজা খুলে অবাক হয়ে যান শুভ্রা।”হ্যালো আন্টি,আমি পর্ণার বন্ধু প্রজ্ঞা।পর্ণা আছে?”..’যদি তুমি কোনো কাজে লেগে থাক তাহলে সফল হবেই’…এই  বিশ্বাসের জোরে প্রজ্ঞা শেষ অবধি পর্ণার শ্বশুরবাড়ির ঠিকানায় পৌছেই যায়।অপরূপা সুন্দরী মেয়েটার হাসি,চোখ,পোশাক কোনোটাই ভালো লাগেনা শুভ্রা দেবীর,তাও মুখে মৃদু হাসি এনে বলে,”তোমায় তো ঠিক চিনলামনা।আসলে সুস্মিতা ছাড়া কেউ এখানে আসেনি তো আগে।…বাইরে দাঁড়িয়ে কেন ,ভেতরে এস।”মনের মধ্যে অস্বস্তি চলতে থাকে উনিভার্সিটির কেউ নয়তো!শুভ পর্ণার সম্পর্ক তো ওখানে প্রকাশ্য নয়।কিন্তু বাড়ির দরজায় আসা অতিথি,বিশেষ করে পুজোর দিনে,ফেরাবেন কিকরে!গলার স্বরটা শুনে অবিশ্বাস আর বিস্ময় নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে পর্ণা।প্রজ্ঞা কে দেখে বিশ্বাস হয়না প্রথমে,প্রজ্ঞাই প্রথম বলে ওঠে,”কেমন সারপ্রাইজ দিলাম বল! শেষদিন কুরিয়ারের ডেলিভারি বয়-কে যখন তুই বাড়ির এড্রেস বোঝাচ্ছিলি তখন কানে গেছিল,ওতো খেয়াল করিনি।আজ এদিকে ঠাকুর দেখতে এসে হঠাৎ মাথায় তোর কথা গুলো ভেসে উঠলো,একটু খুঁজতেই পেয়ে গেলাম।বল কেমন অবাক হলি?!”প্রজ্ঞার কথায় মনে হচ্ছিল যেন পর্ণা ওর প্রানের বন্ধু।শুভ্রা দেবীও ওর কথার ধরনে নিশ্চিন্ত হয়ে বলেন,”দাঁড়িয়ে কেন?বসো না।আমি বরং একটু জল মিষ্টি আনি।…পর্ণা তুই তোর বান্ধবীর সাথে একটু কথা বল”। বলে উনি রান্নাঘরের দিকে চলে যান।মামনি রান্নাঘরে যেতেই চাপা গলায় পর্ণা বলে ওঠে,”তুই হঠাৎ আমার শ্বশুরবাড়িতে!আর তাছাড়া কলকাতা ছেড়ে তুই মফস্বলে ঠাকুর দেখতে এসেছিস?!!”পর্ণার গলার অবিশ্বাস প্রজ্ঞার কান এড়ায়না।কিন্তু ওই যে প্রজ্ঞার চরিত্র,ওসব এড়িয়ে বলে ওঠে,”তোর হাবির সাথে আলাপ করাবিনা?”কথা বলতে বলতে প্রজ্ঞার চোখ পর্ণাদের দুজনের ফটো খুঁজতে থাকে।ঠিক সেই মুহূর্তে ভেজিয়ে রাখা দরজা ঠেলে শুভঙ্কর বাড়ী ঢোকে বলতে বলতে,”উফফ পর্ণা লুচির গন্ধে পেটে ছুঁচো নাচানাচি করছে…খেতে দাও,খেতে…”।মুখের কথা শেষ করতে পারেনা হঠাৎ চোখের সামনে প্রজ্ঞাকে দেখে।কয়েক মুহূর্ত নিজেকে সামলে নেয় শুভ,পর্ণাকে বলে ওঠে,”আরে প্রজ্ঞা তোমায় সত্যি ভালোবেসে ফেলেছে।পুজোর দিনে ও আমাদের অতিথি হয়ে এসেছে,ওকে দাঁড় করিয়ে রেখেছো?খেতে দাও কিছু।”তারপর প্রজ্ঞার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে,”ভালোই করেছ তুমি পর্ণার শ্বশুরবাড়ি এসে।মা’র সাথে আলাপ হলো,পর্ণার মামনি? আর হ্যাঁ, আমি এস.এস,শুভঙ্কর সেন,পর্ণার স্বামী।আশা করি এবার তোমার সব কৌতুহলের নিরসন হবে?”ততক্ষনে প্রজ্ঞার মুখ সাদা ব্লটিং পেপারের মতো হয়ে গেছে,যেন কেউ সমস্ত রক্ত শুষে নিয়েছে ওর মুখ থেকে।ও ভেবেছিল পর্ণার স্বামীর কাছে এসে ইনডিরেক্ট ওর চরিত্র নিয়ে হিন্টস দিয়ে যাবে।কিন্তু এত বড় সারপ্রাইজ এর কথা ও দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি।যাকে ওর জীবনের সেরা বাজি মনে করেছিল,নিজের ওপর ওভার কনফিডেন্সের কারণে তাকে নিয়ে কোনো হোমেওয়ার্ক ই করেনি।করবেই বা কিকরে!সোশ্যাল মিডিয়ার সব প্রোফাইল ওঁর লকড।আর পর্ণার প্রোফাইলে লাস্ট ছমাস আপডেট ও করা হইনি।কিন্তু এত বড় সত্যি যে এরা লুকিয়ে রাখতে পারে প্রজ্ঞার মতো শোও-অফ করা মেয়েদের পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব না। অনেক চেষ্টা করেও ও আর ভালো মানুষী মুখোশটা পরে থাকতে পারেনা।ওর মনেহয় আশেপাশের সব ভেঙে চুরমার করে দিতে।আর ..আর …ওই পর্ণাকে প্রাণে মেরে দিতে।কিছু করতে না পেরে ওকে বসতে দেওয়া চেয়ারটা সরিয়ে দিয়ে শুভদের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে চলে যায়,আর যাওয়ার সময় সপাটে দরজাটা টেনে দেয়,আওয়াজ করে বন্ধ হয়ে দরজা অটো লক হয়ে যায়।চমকে উঠে শুভ্রা দেবী বলে ওঠেন,”কি হলো ওই মেয়ের?”ভয়ে পর্ণা বাঁ হাত দিয়ে শুভর ডান বাহুটা চেপে ধরে,তার ওপর শুভ নিজের বাঁ হাতে চাপ দিয়ে ভরসা দেয়।জীবনে কিছু পাওয়া হিসেব মেনে হয়না।যেমন ভালোবাসাটাও হয়না শুধু একটা মনের চাওয়া মেনে।রূপ বা গুণের থেকে হয়তো মনের টান অনেক বড় হয়,একটা চোখের গভীরে হারিয়ে গিয়ে আর একটা চোখ ভালোবাসা খুঁজে পায়।হয়তো বা ভগবানের ইচ্ছায় আগে থেকে ঠিক হয়ে আসে সবটা।কি অদ্ভুত এই একটা সম্পর্ক,মা বাবা সব রক্তের সম্পর্কের থেকেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায় সময়ের নিয়মে।কখনো দুটো সম্পূর্ণ অচেনা মানুষ,বা সম্পর্কের সংজ্ঞা বদলানো দুটো স্বল্প চেনা মানুষ বা একসাথে সব টুকু জেনে ছোট থেকে বড় হওয়া দুটো মানুষও একে অপরের ভরসা ,বিশ্বাস,নির্ভরতা হয়ে ওঠে।সব সময় সবটা ঠিক হয়না হয়তো,কিন্তু তাও কিছু তো থাকেই সব সম্পর্কের অন্তরালে,সাত পাকের বাঁধন ভালো খারাপ মিলিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অটুট থেকে যায়।আর যেগুলো ভাঙে তাতে হয়তো থেকে যায় বিশ্বাস বা  ভরসার অভাব।তৃতীয় ব্যক্তি তখনই ঢোকে যখন নিজেদের মধ্যে কোনো একটা কিছুর অভাব হয়।

উনিভার্সিটির ক্লাস শুরু হওয়ার পর প্রথম দুদিন প্রজ্ঞাকে দেখা যায়না।পর্ণার টেনশন কিছুটা হলেও কম হয়।শুভ সেদিন স্টাফরুম বসেছিল লাঞ্চ টাইমে, হঠাৎ সিঁড়ির দিক থেকে পর্ণার প্রাণখোলা হাসির আওয়াজ পায়।ওর মুখেও মৃদু হাসি ফুটে ওঠে,যাহোক মেয়েটা অন্তত টেনশন ভুলে সুশীর সাথে একটু নরমাল থাকছে।কিন্তু পরক্ষণেই চোখটা জ্বালা করে ওঠে,দেখে পর্ণা ফাইনাল ইয়ারের অভিকের সাথে নামছে,কিন্তু অভিকের কোনো কথায় পর্ণা হাসতে হাসতে চোখে প্রায় জল এসে যাচ্ছে।যদিও শুভ বলেছিল পর্ণার উনিভার্সিটির কোনো কিছুতেই ও কিছু ইন্টারফেয়ার করবেনা।কিন্তু এরকম পর্ণাকে ও কোনোদিনও দেখেনি বলে এটা ওর কাছে অসহ্য লাগে।মনে হয় এখুনি ছুটে গিয়ে পর্ণাকে টেনে আনতে,কিন্তু পর্ণা স্টাফরুমের দিকে একবারও না তাকিয়ে সোজা নীচে নেমে যায়।এস.এস এর মুখটা কঠিন হতে থাকে আস্তে আস্তে।

You may also like

Leave a Comment

error: Content is protected !!